লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড!
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। নির্বাচন এলেই কথাটা বেশি উচ্চারিত হয় রাজনীতিবিদদের মুখে। তাদের মুখের কথা বুঝিয়ে দেয়, রাজনীতি একটা খেলা। কারো কারো মত অনেক বড় খেলা। জটিল খেলা। সে রকম একটা খেলার জন্য একটা বড় মাঠই দরকার। আর সেই মাঠের দাবি রাজনীতির সব খেলোয়াড়রাই করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে; লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আসলে কী!
উত্তরটা ছোট করে বলা যায় না। কেউ বলেনও না। বরং সবাই ভাবার্থই বোঝাতে চান। মোটা দাগে যার অর্থ সবার জন্য বা সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ। আবার যারা বেশি বিশুদ্ধ বাংলায় বিশ্বাসী তারা বলেছেন; সবার জন্য সমান ভূমি! বা সমতল ভূমি!
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বাংলা যাই হোক; রাজনীতিবিদদের কাছে এর অর্থ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ। তবে মুখে বললেও তারা কথাটায় বিশ্বাস করেন কী না সন্দেহ আছে। আজ যারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য জোরালো আওয়াজ তুলছেন, তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন অন্যের জন্য তারা সমতল ভূমি তৈরি করতে চাননি।
আবার এখন যারা ক্ষমতায়, তারা তখন এই সমতলভূমি খুঁজে বেড়িয়েছেন আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে। অতীতে রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আস্থা-অনাস্থার জন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হয়েছে। কিংবা তারা ক্ষমতায় চলে এসেছেন! কিন্তু তাতেও কী সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়েছে নির্বাচনে?
নির্বাচনে হারলে কেউ স্বীকার করেননি তারা সমান সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। একইভাবে প্রচার-প্রচারণা করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু জনগণ তাদের ভোট দেননি। বরং তারা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কেউ বলেছেন কারচুপি হয়েছে। কেউ বলেছেন সূক্ষ্মকারচুপি হয়েছে। কেউ বলেছেন মিডিয়া ক্যু হয়েছে। কেউ বলেছেন, ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে। পরোক্ষভাবে যে দল হেরেছে তারা জনরায়কেই অস্বীকার করেছে! বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে এটাও এক ট্র্যাজেডি। জনরায়ের প্রতি আমাদের রাজনীতিবিদরা খুব একটা সম্মান দেখাতে অভ্যস্ত নন।
যারা জনগণের রায় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পেলেও তাকে অসমতল ভূমি বলবেন এটা খুব স্বাভাবিক। যে কারণে, তারা নির্বাচন এলে আগে চায় সরকার পতন। বা সরকারের পদত্যাগ। সাতচল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশকে এখনও খুঁজতে হয় নির্বাচন পরিচলানার জন্য একটা নির্দলীয় সরকার! অথচ এই দেশটার জন্মই হয়েছে গণতেন্ত্রর জন্য।
গণতান্ত্রিত শাসন ব্যবস্থার জন্য। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। সেই দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারেনি। অথবা আমরা চালাতে পারিনি। যে কারণে গণতন্ত্রের জন্য অনেক বিকল্প সরকারের প্রস্তাব আসে আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেও!
গণতন্ত্রে কোন নির্বাচিত সরকারের বিকল্প থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে শুধু অধিকতর গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকল্পও উন্নত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। আর সেই সরকার ব্যবস্থার জন্য দরকার নির্বাচন। নির্বাচন পরিচলানা করার কথা নির্বাচন কমিশনের। তারা অধিকতর ক্ষমতাবান হলো কী সেটা যেমন প্রশ্ন তেমনি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার সমক্ষমতা তাদের আছে কী না সেটাও প্রশ্ন।
নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাবান করতে আর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য যদি নব্বই দিনের জন্যও অনির্বাচিত কোন সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়, সেটা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কোন স্বাস্থ্যকর চেহারা হতে পারে না। বরং তাকে বলতে হবে রুগ্ন গণতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক চেহারা।
আসলে বাংলাদেশ গণতন্ত্র মানে একদিনের ভোট উৎসবের বেশি কিছু এখনো কেউ ভাবতে পারেন না। নির্বাচনটা উৎসবের মেজাজে হলেই মনে হলো সব ঠিক। আমরা গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলাম! বিষয়টা মোটেও তা নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদেও সব নির্বাচিত প্রতিনিধি সমানভাবে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন কী না সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিরোধী দল সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারেরই অংশ। বিরোধী দল শক্তিশালী হলে সরকার নিজেও শক্তিশালী হয়। বিরোধী দল সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা রাখলে, সরকারের দুর্বল দিক গুলোকে চিহ্নিত করে তুলে ধরতে পারলে, তাতে সরকারই লাভবান হয়। তারা নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিতে পারেন। আর বিরোধী দলও প্রমাণ করতে পারেন, সরকার পরিচালনার জন্য তারাও প্রস্তুত ছিল, হয়তো সংখ্যা তত্ত্বের কারণে তারা বিরোধী দলের আসনে।
আবার বিরোধী দল সংসদে শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে ওয়াক আউট করলেন, কিংবা ফাইল ছুঁড়ে মারলেন স্পিকারকে লক্ষ্য করে সেটা মোটেও ভাল গণতন্ত্রের নমুনা নয়। তবে হ্যাঁ, বিরোধী দল ওয়াক আউট করবে। আবার সংসদে ফিরবে। এটাও সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি। ঐতিহ্য। তবে দিনের পর দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকবেন আবার সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুযোগ সুবিধা নেবেন সেটা অনৈতিক।
এই নীতি-নৈতিকতার কথা ভুলে যান অনেক সাংসদ। তারাও কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলেন নির্বাচন এলে। আবার নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়ে যদি বিরোধী দলে বসতে হয়, তখন তারা থাকেন অনুপস্থিত। কারণ হিসেবে বলেন, সংসদে কথা বলতে দেয়া হয় না!
হ্যাঁ, সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আপনারা যাবেন কথা বলতে। আইন প্রণেতা হিসেবে কথা বলবেন। জনগণের কথা বলবেন। কিন্তু সংসদ অধিবেশনে কতোটা সময় জনগণের জন্য কথা বলেন আর কতোটা সময় বিরোধীদের বিপক্ষে কথা বলেন, নিজেরাই তার একটা অনুপাত করে দেখতে পারেন। শুধু দলীয় নেতা-নেত্রীর প্রশংসা আর অন্যদের নেতিবাচক সমালোচনার জন্য জনগণ আপনাদের ভোট দিয়েছেন কী না সেটাও একটু ভেবে দেখা জরুরি।
তবে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শুধু রাজনৈতিক দল বা জোট, ঐক্যফ্রন্টের জন্য তা নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হতে হবে সবার জন্য। সেটা ভোটার থেকে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য। ভয়হীন, সংশয়হীন, সংকোচহীন ভাবে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে, সেটাই বরং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বড় উদারহরণ হতে পারে।
সাধারণ মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন যেখানে দাঁড়িয়ে, তেমন একটা জায়গা পেলেই তাঁকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হিসেবে দেখবেন। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা সেই ফিল্ডটাকে সমতল হিসেবে দেখেন শুধু নিজেরা জিততে পারেন এমন একটা অবস্থা হলে!
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/পিআর