ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অ্যান্টিবায়োটিক যখন কাজ করে না!

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ১০:৩৮ এএম, ২২ নভেম্বর ২০১৮

একটা সময় ছিলো যখন শরীরে ইনফেকশন হলে তা সারিয়ে তোলার কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু গবেষণাগারে হঠাৎ আবিষ্কৃত এক ধরনের ছত্রাকের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার ক্ষমতা দেখে বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং অবাক হয়ে যান। সময়টা ১৯২৭ সাল। গবেষণা করে দেখা গেলো, সেই ছত্রাক পেনিসিলিয়াম প্রজাতির অর্ন্তভুক্ত। যদিও এর ব্যবহার হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৪১ সাল অবধি।

পেনিসিলিয়াম প্রজাতির থেকেই প্রথম আবিষ্কৃত হয় যে অ্যান্টিবায়োটিক সেটাই বাজারে পেনিসিলিন নামে পরিচিত। তবে এটা ঠিক, অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে মানুষ প্রাকৃতিক নানা উপায়ে ক্ষত সারানোর চেষ্টা করতো। তবে, এটাও ঠিক তা অনেক সময়ই ব্যাকটেরিয়ার বেড়ে ওঠাকে ঠেকাতে পারতো না। ফলে যক্ষ্মা, কলেরা, প্লেগ, কুষ্ঠ ইত্যাদি হলে মানুষের মৃত্যু হতো অসহায়ভাবে।

এই যে পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এলো মানুষের জীবনে সেটাই পরে পথ দেখালো নানারকম অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজনিত রোগ থেকে আমাদের বেঁচে থাকার দারুণ এক উপায় হিসেবে। আবিষ্কার হতে থাকলো নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। একটা সময় ছিলো যখন বলা হতো “যার হয়েছে যক্ষ্মা, তার নেই রক্ষা”—মানে মৃত্যু অবধারিত। কুষ্ঠকে দেখা হতো কোনো ব্যক্তির চরমতম পাপের ফলে সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত অভিশাপ হিসেবে। এখন সেসব ধারণা পাল্টেছে মূলত অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কারণেই।

তবে, দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, জীবন বাঁচানোর এ ধন্বন্তরী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ এখন আমাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে তার কর্মক্ষমতা হারাতে বসেছে। এখন অনেক এন্টিবায়োটিক আর ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারছে না। পরীক্ষা করে দেখা গেছে এসব ওষুধের বিরুদ্ধে ঐ সকল ব্যাকটেরিয়া তাদেরকে ওষুধ প্রতিরোধী করে ফেলেছে।

এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত ইনফেকশান বা ক্ষত নিরাময়ের আর কোনো উপায় থাকবে না। ফলে ব্যাকটেরিয়াঘটিত জ্বর, কলেরাতেই অসহায়ের মতো আমরা আবার হয়ত মারা পড়তে থাকব; অতীতে যেভাবে মানুষ মারা পড়েছে। আগের মতোই গ্রামের পর গ্রাম হয়ত উজাড় হয়ে যাবে ডায়রিয়া, কলেরা হওয়ার ফলে। অন্য সব জটিল ও কঠিন রোগের কথা না হয় বাদই দিলাম।

তাই, সময় এসেছে আমাদের সকলের সচেতন হওয়ার। রোগী, চিকিৎসক, ফার্মেসির দোকানদার সবাইকে সচেতন হতে হবে। সামান্য সর্দি, কাশি , জ্বর হলেই মুড়ি মুড়কির মতো দু’চার দিন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। নিয়মিত ডোজে এবং পূর্ণ মেয়াদে তা খেতে হবে।

সব থেকে ভয়াবহ এই যে অবস্থা অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অবস্থা এর জন্য আমাদের দেশে যত্র তত্র গড়ে ওঠা ওষুধের দোকান আর মানহীন ওষুধ কোম্পানিগুলো দায়ী। মানহীন ওষুধ কোম্পানিগুলো মানহীন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে বেশি লাভের আশায়। আর এসব ওষুধ খেয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলো ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।এর সাথে যুক্ত হয়েছে ওষুধের দোকানগুলোর বাছ বিচারহীনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা। কিছু হলেই এরা দু’চার ডোজ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেয়। পরে দেখা যায় প্রয়োজনের সময় ঐসব ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করলেও তখন আর রোগ সারাতে পারে না। এর পেছনে কারণ কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অপরিকল্পিত এবং না বুঝে, না জেনে ব্যবহার করা।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার এ দৌরাত্ম্য কমাতে হলে প্রথমেই আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। প্রতিজ্ঞা করতে হবে, রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া নিজে নিজে বা ওষুধের দোকানের দোকানীর কথায় অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া।

রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ এবং প্রেসক্রিপশন মতো পূর্ণ মাত্রায় পূর্ণকালীন সময় ওষুধ সেবন করা। ওষুধের দোকানগুলো যেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বেঁচতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর হওয়া। আর মানহীন ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তা বন্ধ করা। তাহলেই হয়ত ধীরে ধীরে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। না হলে অদূর ভবিষ্যতে অকাল মৃত্যু রোধ করা কঠিনই হবে।

“অযথা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন অযথা ক্ষতির কারণ, বিনা প্রেসক্রিশনে তা কিনতে বারণ” বিশ্ব এন্টিবায়োটিক সপ্তাহ (১২-১৮ নভেম্বর), ২০১৮ এর এই স্লোগানকে আমরা যেন সবসময় মনে রাখি। তাহলেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্সের কারণে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুরোধ করা সম্ভবপর হবে।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/আরআইপি