চাই প্রকৃত শিক্ষা, প্রকৃত মানুষ
এক সময় এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা ছিল যখন নারীরা শুধু সন্তান জন্ম দিত কিন্তু সন্তান লালন-পালনের কাজটি পুরুষেরাই করতো। ধীরে ধীরে পুরুষেরা ক্রমাবর্তনের মধ্যদিয়ে তাদের কাজের ধারা পরিবর্তন করলো নারীদের সাথে। যেখানে নারীরা বাহিরের কাজ করতো সেখানে পুরুষেরা বাহিরের কাজ করা শুরু করে দিল। আর সন্তান উৎপাদনের সাথে সাথে সন্তান লালন-পালন করতে শুরু করলো নারীরা।
ঠিক জানিনা, কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে নাকি পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে তারা তাদের সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের ধারা পরিবর্তন করলো। কথাগুলো বলা এজন্য যে, মনে হয় সমাজের রীতি নীতি, নিয়ম কানুন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার আগে মানুষের প্রয়োজন আত্মার উন্নয়ন ঘটানো। যে মানুষের আত্মা যতো বেশি উন্নত সে ততো বেশি সমাজের ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা রাখে এবং তা বিচারের ভার সেইসব উন্নত নৈতিকগুণসম্পন্ন মহৎ মানুষের উপর থাকা উচিৎ।
ওজন বৃদ্ধির জন্য যেমন চাই পরিমিত সুষম খাদ্য, যা নিশ্চিতভাবে একটা প্রাণির জন্য ন্যূনতম পরিমাণে থাকা উচিৎ। আত্মার উন্নয়ন তেমন নয়। তা নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে অবস্থিত কোন জ্ঞান অাহরণের মধ্য দিয়ে লাভ করা যায় না । তার জন্য চাই অবাধ জ্ঞানের আকর যা শুধু তাকে সংস্কৃতিবান হতেই শেখাবে না, শেখাবে পরিমার্জিত, পরিশীলিত রুচিবোধ, বাড়াবে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাশীলতা যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে, কর্ম-পদ্ধতিরও উন্নয়ন ঘটাবে।
এভাবে লক্ষ-কোটি সংস্কৃতিবান সৃজনশীল মানুষ যদি বহুবিধ কাজের সাথে যুক্ত থাকে তবেই একটি জাতি, একটি দেশ উন্নতি লাভ করবে। অব্যাহত থাকবেউন্নয়নের ধারাও। অসভ্য মানুষ অসভ্য জাতি তৈরি করে আর অসভ্য জাতি কালে কালে পরাভূত হয়। মন ও মননশীলতার উন্নয়নের জন্য চাই সংস্কৃতি আর কর্মপদ্ধতির উন্নয়নের জন্য চাই বিজ্ঞানচর্চা। সংস্কৃতি একটি দেশের, সমাজের কিংবা মানুষের আচার অনুষ্ঠানের রূপভেদ যা ঐ দেশের, সমাজের কিংবা মানুষের নিজস্বতা, যা তাকে স্বতন্ত্র করে তুলবে।
আর বিজ্ঞান গবেষণালব্ধ জ্ঞান বা সত্যের প্রকাশ যার প্রমাণভিত্তিক প্রতিষ্ঠা রয়েছে তা একটা মানুষকে যুক্তিশীল ও বিবেচনা বোধ-সম্পন্ন হতে শেখাবে। তাই একটি দেশের প্রতিটি স্তরের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ ও প্রসার ঘটাতে হবে । এটা সম্ভব হবে দেশের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা ও পাঠদান নিশ্চিতকরণের মধ্যদিয়ে। একটা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সেটা নিশ্চিত করতে পারে।
রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ, ৭২ এর সংবিধান এর মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ- এই চার মূলনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে মানবিকরূপে প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে রাষ্টের নাগরিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ সকল মৌলিক অধিকার পূরণ করার জন্য সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখলকারীরা রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্রের মানবিকতা নির্বাসনে চলে যায়। নব্বই এর দশকে এসে শিক্ষাখাতও আক্রান্ত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এর কারণে ব্যাঙের ছাতার মত সারাদেশে গড়ে ওঠে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে করে কিছু পুঁজিপতি ও ধনিকশ্রেণি উৎসাহিত হন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য। এর মধ্যদিয়ে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার ষোলো কলা পূর্ণ হয়।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা ধরনের কলেজ থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছেনা সমাজের সকল শ্রেণির, সকল পেশার বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের সন্তানেরা। কেন না শিক্ষা ব্যয়বহুল। অর্থাৎ তার মানে এদেশের একজন নাগরিককে শিক্ষিত ও মানবিক করে গড়ে তোলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারেনি।
শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তার সমাজের প্রতিটি পরিবারে না ঘটলে সমাজে অপরাধ-প্রবণতা , দুর্নীতি ইত্যাদি বেড়ে যায়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ঘটিত হত্যা, খুন, গুম তার স্পষ্ট প্রমাণ। দৃশ্যমান এসব ভয়াবহ সত্যের আড়ালে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা।
একজন মানুষ কখনই অপরাধী হতে পারেনা যদি তার সেই প্রকৃত-শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের সাথে যোগসূত্র থাকে। আর তখন একজন মানুষ শুধু চিন্তা করবে কিভাবে অধিকতর ভাল হওয়া যায়, শিখবে, কিভাবে মানুষ হত্যার জন্য নয় মানুষের মুক্তির জন্য বেপরোয়া হতে হয়।
লেখক : গবেষক।
এইচআর/আরআইপি