ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচনী ডিগবাজি!

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:২২ এএম, ১২ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আদর্শ বলে কিছু নেই। সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবীটাই আসল। নির্বাচন এলেই দলবদলের হিড়িক পড়ে যায়। যেই দল থেকে মনোনয়ন পাবেন, সেই দলেই যোগ দেন। আগের রাতে বিএনপির মনোনয়ন চাওয়া লোকটি ব্যর্থ হয়ে পরদিন নৌকায় উঠে গেছেন; এমন উদাহরণ অনেক। তবে এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যক্তিগত দলবদলের প্রবণতা খুব বেশি নেই।

কিন্তু দুদিন আগে এটিএন নিউজের ক্যামেরাপারসন মনির এসে বললো, ভাই দলবদল নিয়ে কিছু একটা লেখেন। আমি পড়বো। শুনে আমি বললাম, এবার তো দলবদল হয়ইনি। লিখবো কী। এরপর মনির দলবদল নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলেন, তাতে আমি চমকে গেলাম। তাই তো ব্যক্তিগত দলবদল তেমন হয়নি বটে, তবে দলগুলোই এবার পক্ষবদল করেছে। তাতে একাকার হয়ে যায় আদর্শিক বিষয়গুলো।

মাঠে এখন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। মজার ব্যাপার হলো ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি ছাড়া বাকি দলগুলো সব সাবেক আওয়ামী লীগারদের গড়া। আ স ম আব্দুর রব তো সেই বাহাত্তরেই ছাত্রলীগ ছেড়ে জাসদ গড়েছেন। ড. কামাল নব্বই দশকের শুরুতে আর কাদের সিদ্দিকী শেষে আওয়ামী লীগ ছেড়ে নিজ নিজ দল গড়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আর সুলতান মনসুরের গা থেকে তো এখনও আওয়ামী লীগের গন্ধ যায়নি। আওয়ামী লীগের এই দুই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তো ১/১১এর শিকার।

এছাড়া ড. কামালের দলের মোস্তফা মহসিন মন্টু, মান্নার দলের এস এম আকরামও আওয়ামী লীগ থেকে আসা। এইসব সাবেক আওয়ামী লীগাররা মিলে এখন দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপিকে খাদ থেকে টেনে তোলার। সংলাপের দ্বিতীয় দিনে শেখ হাসিনা একজন একজন করে সবার রাজনৈতিক ঠিকুজি বর্ণনা করেছেন। দেখা গেল ১১ জনের মধ্যে এক মির্জা ফখরুলই সাবেক বাম, বাকি সব সাবেক আওয়ামী লীগার। ব্যারিস্টার মওদুদ একসময় বঙ্গবন্ধুর পিএস ছিলেন, এমনকি ড. মোশাররফও ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। ক্ষমতায় যাবার আশায় বিএনপিকে এখন ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ডাক সইতে হয়।

সাবেক আওয়ামী লীগাররা শেখ হাসিনাকে সরাতে বদ্ধপরিকর হলেও তাদের মুখে বঙ্গবন্ধু ছাড়া কথা নেই। সুলতান মনসুর আর কাদের সিদ্দিকী তো মুজিব কোট পড়েই সমাবেশে যান। তবে নব্য বিএনপিবন্ধুরা বিএনপির চেয়ে বেশি গরম। মাহমুদুর রহমান মান্না খালেদা জিয়ার জন্য জান দিতে চান, কাদের সিদ্দিকীর কাছে খালেদা মানেই বাংলাদেশ। আর আ স ম রবের বক্তৃতা শুনলে তো মনে হয় এখন ২০১৮ নয়; ৭২-৭৫এর জাসদের উত্তেজনা তার কণ্ঠে। রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য শুনে মির্জা ফখরুল তো বটেই, আমার ধারণা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও লজ্জা পান। তারা উত্তেজনার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন বুঝি।

অনেকে বলেন, এসবই রাজনীতিবিদদের মেঠো বক্তৃতা। সবকিছু ধরতে নেই। শুনে আমি আরো চমকে যাই। যাদের ওপর আমাদের ভূত-ভবিষ্যৎ, আশা-আকাঙ্খা, যারা দেশ চালান; সেই রাজনীতিবিদদের কথাই যদি বিশ্বাস না করি; তবে কার কথা বিশ্বাস করবো, কার ওপর আস্থা রাখবো?

এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে সাবেক বিএনপি নেতারা এখন আওয়ামী লীগের পাশে। সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার প্রাথমিক উদ্যোগ ছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর। শেষ মুহূর্তে ঐক্যফ্রন্ট থেকে ছিটকে পড়া বি চৌধুরী যুক্তফ্রন্ট পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে ২০ দল থেকে দল ভাগিয়ে তিনি নিজের দল ভারী করছেন। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বি চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের বন্ধু। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন স্থায়ী কমিটির কনিষ্ঠতম সদস্য ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা অবশ্য বি চৌধুরীর মত অত কৌশলী নন।

বি চৌধুরী তবু চক্ষুলজ্জা রেখে আওয়ামী লীগের সাথে দর কষাকষি করছেন। কিন্তু নাজমুল হুদা এতকিছুর ধার ধারেননি। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও নির্লজ্জের মত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। অথচ বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর 'তৃণমূল বিএনপি' নামে নিজে একটি দল করেছেন; বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স-বিএনএ নামে জোট করেছেন। এই দল আর জোট নিয়ে ১৪ দলে বিলীন হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। ব্যর্থ হয়ে সরাসরি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইছেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবার এত মরিয়া, কারণ তার গতবারের অভিজ্ঞতা ভালো না।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে প্রথমে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ গঠন করেছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আবুল কালাম আজাদ নামে এক উটকো লোক ব্যারিস্টার হুদাকে বহিষ্কার করে নিজেই বিএনএফ নেতা বনে যান এবং বাগিয়ে নেন গুলশানের আসন। বিএনএফ-এর আবুল কালাম আজাদ ৫ বছর ধরে দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকার এমপি আর বিএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার হুদা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছেন; এটাই ব্যারিস্টার হুদাকে বেপরোয়া করে তুলেছে হয়তো। আসন সমঝোতায় বি চৌধুরী অন্তত ৫টি পেতে আশা করবেন, আমার ধারণা ৩টির বেশি পাবেন না।

তবে নাজমুল হুদাকে সামাল দিতে একটা আসনই যথেষ্ট। তবে সেটা দোহার না গুলশান- এই নিয়ে বেচারা বড্ড পেরেশানিতে আছেন।দোহারে তার চাচা সালমান এফ রহমান আগে থেকেই লাইনে আছেন। আবার গুলশানের দিকেও অনেকের নজর। তাই ২০১৪ সালের মত এবারও প্রতারিত হবার ভয়ে অস্থির ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা।

আচ্ছা আপনাদের কারো কি বিএনপির ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৫ সময়কার কথা মনে আছে। এই ১০ বছরে ব্যারিস্টার হুদা প্রায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগ ও এর নেতা-নেত্রীদের গালাগাল করতেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। বেশ কিছুদিন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন বলে মিডিয়া তার ফুটপাতের তাবিজ বিক্রেতা স্টাইলের সেই ট্র্যাশ প্রচারও করতো। অবশ্য মানুষ তার ভাড়ামোতে দারুণ বিনোদন পেতো। এখন তিনি প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। সারাক্ষণ খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানের নিন্দা-মন্দ করেন। কিন্তু এখন আর এসব কথা বলার জন্য মিডিয়া পান না।

বলছিলাম নির্বাচনী দলবদলের কথা। ক্যামেরাপারসন মনিরের কথাই ঠিক, এরচেয়ে বড় দলবদল আর আগে কখনো ঘটেনি। এই ডিগবাজি তো সের্গেই বুবকার পোল ভল্টের বিশ্বরেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে। দলছুট আওয়ামী লীগাররা সব বিএনপির পাশে আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব আর প্রতিষ্ঠাকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য এখন ঠাঁই খুঁজছেন নৌকায়। আসলেই লিলা বোঝা দায়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে সত্যি কিছু নেই।

এইচআর/এমআরএম/পিআর

আরও পড়ুন