মানুষের বোধ, ইচ্ছে, স্বপ্ন এবং কিছু ভাবনা
ম্যাক্সিম গোর্কির চেলকাশ নামে একটি ছোটো গল্প পড়েছিলাম। গল্পের মূল চরিত্র চেলকাশ চালচুলোহীন ভবঘুরে একজন মানুষ। চুরি করা তার পেশা। এক রাতে সে চুরি করতে যায়। এই চুরির অভিযান নিয়েই এই গল্প।
চুরি করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরার আশঙ্কাও আছে। লোকটা দুঃসাহসী। ওর সঙ্গে আছে গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা আনাড়ি এক তরুণ। ওর নাম গ্যাব্রিয়েল। চেলকাশ জানতে পারে গ্যাব্রিয়েল তাকে হত্যা করে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল।
এ কথা জেনেও শেষ পর্যন্ত সে গ্যাব্রিয়েলকে টাকাগুলো দিয়েই দেয়। এটা অবশ্যই চেলকাশের মহত্ত্ব। আবার চেলকাশ একবার গ্যাব্রিয়েলকে নৌকা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায় সমুদ্রে। তখন চেলকাশের ভবঘুরে জীবনের বিক্ষিপ্ত ও অসহিষ্ণু মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
সেলিনা হোসেনের একটি ছোটো গল্প 'পারুলের মা হওয়া' পড়লাম কিছু দিন আগে। এখানে পারুল মেয়েটি একজন দিন মজুরের বউ। হঠাৎ একদিন পারুলের স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর সর্বাঙ্গ চেঁচিয়ে ওঠে, আমি তো সব পারতাম। কেনো ও পালিয়ে গেল?
দুদিন পর থেকে ও রাস্তার কাজ শুরু করে। কয়েকদিন পর শুনতে পায় ওর স্বামী মনপুরার চরে গিয়ে ধান কাটে। বিয়েও করেছে। ওর মনে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। ও বুঝে যায় যে লক্ষ্য স্থির করাটা সবচেয়ে কঠিন। দিন যাপনের সবচেয়ে বড় বাধা সিদ্ধান্ত নিতে না পারা।
দু মাস পর ও গর্ভবতী হয়। লেখকের ভাষায়, স্বামী ছাড়া মা হওয়া ভাল না মন্দ এ বোধ ওর মনেই আসে না। মা হয়েছে শুধু এই বোধ ওকে সম্পন্ন মানুষ করে দেয়। ফলে, এই বোধকে বড় করে ধরে রাখা ওর কাছে জরুরি ও একমাত্র বিষয় মনে হতে থাকে।
এখানে পারুল মেয়েটি খুব সাধারণ ও অশিক্ষিত একজন মেয়ে। তারও প্রবল জীবন বোধ আছে। যে পারুল একদিন স্বামীকে হারিয়ে কাতর হয়ে পড়ে, সেই পারুলই আবার জীবনের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়ায়। জৈবিক চাহিদার কাছে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত করে নিজেকে, একটি আবছা অসন্তোষ বুকে নিয়ে।
গল্প দুটো বলার কারণ, আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেনো, সেখানকার গল্পের বা বাস্তব সমাজের মানুষের চরিত্রের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হলো সব মানুষের মনের মধ্যে একই সাথে বিপরীতধর্মী কিছু বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ রয়েছে। মানুষের ইচ্ছেগুলো, স্বপ্নগুলো সময়, বয়স, পরিবেশ, পরিস্থিতির সাথে সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে।
আবার বিভিন্ন মানুষের চিন্তার দ্বারাও মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়ে বা নাটক, সিনেমা দেখে চিন্তার ধরন, দর্শন পরিবর্তন হচ্ছে। আমার মধ্যেও হয়তো এই বোধ কাজ করে। কখনও কখনও মনে হয় ঘর সংসার, স্বামী-সন্তানের দেখভাল করে সহজ ও সাধারণ একটি জীবন পার করে দেব। নিজের কোনো বাড়ি, গাড়ি না থাকলেও চলবে।
আবার এই আমিই অন্য কোনো এক সময় ভাবি, আমার যদি বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি থাকতো! সেই গাড়িতে চড়ে প্রিয় কোনো বন্ধুর সাথে প্রিয় কোনো গান শুনতে শুনতে লং ড্রাইভে হারিয়ে যেতাম! আমার বন্ধুটি হঠাৎ বলে উঠবে, জানিস, তোকে আমি ওই সময় খুব ভালবাসতাম। সাহস ছিলো না বলার। আজ আমি অনেক সাহসী। বয়স বেড়েছে তো। আজও আমি তোকে ভালবেসে রংধনুস্পর্শী দিগন্তে হারিয়ে যাই বার বার।
ঠাট্টা করে অথবা সত্যি সত্যি বলবে, চল, পালিয়ে যাই? আমি শান্ত অথচ মুগ্ধতা চোখে মুখে নিয়ে বলবো, সে সময়, সে বয়স কি আর আছে রে পাগল! আবার কখনও কখনও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখি! দেখি যে আমি লেখালেখি করে জগৎ বিখ্যাত হয়ে গেছি! আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাহিত্য সভা থেকে বক্তব্য দেয়ার জন্য।
আমার বক্তব্যে বিমুগ্ধ জনতা হাততালি দিচ্ছে সজোরে তাদের মনের সমস্ত প্রশান্তি ঢেলে দিয়ে। মানুষের ইচ্ছের, স্বপ্নের শেষ নেই। প্রতিনিয়ত মানুষকে ঘিরে রাখছে তার ইচ্ছে, স্বপ্ন, চাওয়া পাওয়া। দিন শেষে রাত হয়, রাত শেষে ভোর। নতুন ভোরে নতুন কিছু করার ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে যাক মানুষ। এগিয়ে যাক পৃথিবী।
লেখক : গবেষক।
এইচআর/এমএস