ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সংলাপ : প্রলাপ-বিলাপের পূর্বাপরে

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

হট আলোচনায় সংলাপ। মোটা দাগে তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের পর ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে এ সংলাপের বার্তা দিয়েছে সরকার। অনেকটা নাটকীয় ও আকস্মিকভাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এ বার্তা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ক্ষমতাসীন দলের তরফে এ ঘোষণার আগে এদিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা হয়েছে। একইদিনে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও সংশোধন আইন অনুমোদন হয়েছে মন্ত্রিসভায়। পরে সন্ধ্যার দিকে জারি হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন।

অবশ্য প্রজ্ঞাপনটিতে নির্বাচন কমিশন সচিবের সই আগেরদিন ২৮ অক্টোবরের। কিন্তু ইসির ওয়েবসাইটে সেটি এসেছে পরদিন ২৯ অক্টোবর। বলার অপেক্ষা রাখে না একদিনে অনেকগুলো কাজের কাজ হয়ে গেছে ২৯ অক্টোবর। এখনকার কাজ শুধু নির্বাচনের পথে এগিয়ে চলা।

এতোদিন নানা কথা বলা হলেও এখন আর কারোই বুঝতে বাকি নেই রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির পরও আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রচলতি পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে ইভিএম চালু হচ্ছে। সংসদ অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ায় আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়ে যাবে।

ইভিএম নিয়ে আলাপ-সংলাপও কম হয়নি। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করে আসছে। তাদের আশঙ্কা এই ব্যবস্থায় সরকার ভোট কারচুপি করবে। এর আগে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে কমিশনের এ সংক্রান্ত বৈঠক ত্যাগ করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এসব ঘটনা এখন তামাদির খাতায়।

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি ঝুলে ছিল অনেকদিন থেকে। আর বাতিলের প্রসঙ্গ তো ঝুলছেই। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। তবে তখন থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি নির্বাচন কমিশন। নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে জামায়াতের নেতারা দলীয় পরিচয়ে আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে স্বাধীনভাবে অর্থাৎ ব্যক্তি পরিচয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো প্রতীকে তাদের নির্বাচন করতে হবে। কোনোভাবেই জামায়াতের পরিচয় তারা ব্যবহার করতে পারবেন না।

বলার অপেক্ষা রাখে না বুঝেশুনেই বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের পথে পা বাড়িয়েছে সরকার। ২৯ অক্টোবর সকাল-দুপুর, বিকালেও বলা হয়েছে সংলাপের প্রশ্নই আসে না। ঐক্যফ্রন্টের সাতদফার একটিও মানার মতো নয়। সন্ধ্যা নাগাদ একেবারে ইউটার্ন। সংবাদ সম্মেলন ডেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার দরজা কারও জন্য বন্ধ নয় বলে নতুন ও অসাধারণ বার্তা দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তার ভাষায়: আমাদের নেত্রী ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবে রাজি এবং তাদের সঙ্গে সংলাপে বসব। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তিনি বলেন, আমি এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সমগ্র দেশবাসীর জন্য প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ দেব, যা সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে দেবে।’

তিনি জানান, ‘আজকে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর নেত্রী তাদের নিয়ে একটি অনির্ধারিত বৈঠক করেন। উপস্থিত দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সবার মতামত জানতে চান। অনির্ধারিত এ আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছ যে আমাদের নেত্রী ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবে রাজি এবং তাদের সঙ্গে সংলাপে বসব।’

এর আগে, ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে ড. কামাল হোসেনের সই করা একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ড. কামাল সংলাপ করতে চেয়েছেন। একদিনের মধ্যেই ফলাফল। তবে, প্রলাপ-বিলাপ এখনো রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, আলোচনা তো বিএনপির সঙ্গে হচ্ছে না।

আলোচনা হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে। বাস্তব এতো সহজ-সাবলীল নয়। এরপরও ক্যাচাল, প্রলাপ, বিলাপের চেয়ে সংলাপের মাধ্যমে একটা ফয়সালার আশা করাই যায়। আশা না থাকলে মানুষের বাঁচাও নিরর্থক হয়ে যায়। জীবন যেখানে দ্বান্দ্বিক। রাজনীতি সেখানে দ্বন্দ্বহীন হবে কোন আশায়?

রাজনীতির দ্বন্দ্বটা যতো না আদর্শিক তার চেয়ে বেশি ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে। দেশের জন্য, আদর্শের জন্য রাজনীতি, এগুলো আগেই ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক আর্কাইভে। এরপরও বিলাপের একটা ফুলস্টপ দরকার। আর কতো? সংলাপ নিয়ে নাগরিক জীবনে প্রলাপের সাথে বা আগে-পরে বিলাপও কম নয়।

রাজনীতির ময়দানে সংলাপের ডিমান্ড। সুশীল সমাজেও সংলাপের তাগিদ। কূটনীতিকরা বলছেন সংলাপের কথা। তবুও হচ্ছিল না। এই হচ্ছে না, হচ্ছে নার মাঝেও অনেক কিছু হয়ে গেছে। যা অনেকের চোখ-কান এড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে।

বাঙালির জনজীবন রাজনীতিময়। আগে-পিছে নেই, লাভ-লসেও নেই-এমন গোষ্ঠীও ক্ষুদ্র দলতান্ত্রিক রাজনীতিতে যারপরনাই আসক্ত। দলের বাইরে তারা কিছু দেখে না। দলীয় নেতানেত্রী তাদের কাছে পীরের আসনে। রাজনীতিবিদদের খ্যাপা মানসিকতা কর্মী-সমর্থক হয়ে সাধারণ দাবিদার মানুষের মধ্যেও সংক্রামিত। সমাজের স্তরে স্তরে গতিময়। তা ক্ষেত্র বিশেষে মহামারির মতো।

সংলাপের ফলাফল অবশ্যই ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে, সংলাপের উছিলায় রাজনীতির উত্তেজনা আপাতত কিছুটা হলেও কমবে- তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অতীত তিক্ত হলেও বর্তমানটা স্বাভাবিক হলে সুন্দর একটা ভবিষ্যত তো আশা করাই যায়। সংলাপের অংশীজনরা আন্তরিক হলে মন্দের ভালো হলেও একটা ফয়সালার আশা নানা মহলেই। সেই ক্ষেত্রে চাতুরিটা অবশ্যই বর্জনীয়। ছোটবেলায় পড়া এবং শোনা সেই গল্পটি এখানে প্রাসঙ্গিক।

গল্পটি এমন... শিক্ষার কিছু আলো পড়েছে দুই গ্রামেই। ধনে-জনে কেউ কারো কাছে ফেলনা নয়। দুই গ্রামই কে বড়, কে ছোট এটা প্রমাণ করতে মরিয়া। একে অন্যকে দেখিয়ে দেওয়ার শো-ডাউনে মত্ত। এক গ্রাম ফুটবল খেলার আয়োজন করলে অন্য গ্রাম হাডুডু টুর্নামেন্ট ঘোষণা করে মাতিয়ে দেয়। এই গ্রামের তালুকদার বাজার থেকে বড় রুই মাছটা কিনলে ওই গ্রামের বড় মিয়া সবচেয়ে বড় বোয়াল মাছটা কিনে হাকডাক দেন। আওয়াজ তুলে ওই গ্রামের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরে।

একজন ভাবলো গ্রামের উন্নয়ন করতে হলে সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে। এতে পাশের গ্রামকে বিদ্যা-বুদ্ধিতে হারানো সহজ হবে। তাদের দেখাদেখি ওই গ্রামও স্কুল তৈরি করে। দুই গ্রামে স্কুল গড়ে উঠেছে। শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। এখন বাহাস বসে কোন গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার বেশি বিদ্বান। এই বিতর্ক চরম পর্যায়ে উঠে দুই গ্রামের মধ্যে ঝগড়াঝাটির পর্যায়ে চলে যায়। তখন দুই গ্রামের হোমড়াচোমড়ারা বললেন- ঠিক আছে, প্রকাশ্যে দুই হেডমাস্টারের বিতর্ক হবে। তখনই বোঝা যাবে কে বেশি শিক্ষিত।

তারিখ মতো দুই গ্রামের মাঝের সীমানায় দুই হেডমাস্টারের বিদ্যা পরীক্ষার আসর বসে। সিদ্ধান্ত হলো দুই হেডমাস্টার একে অন্যকে প্রশ্ন করবেন। এক গ্রামের হেডমাস্টার সুবোধ বাবু সোজাসাপটা একটা অঙ্কের প্রশ্ন করলেন। ওই হেডমাস্টার মতলব সঠিক উত্তর দিলেন। এবার তার প্রশ্ন করার পালা। তিনি লেখাপড়ার চেয়ে চাতুরিতে বেশি ওস্তাদ। তিনি প্রশ্ন করলেন, বলুন তো দেখি ‘আই ডোন্ট নো-এর অর্থ কী? জবাবে ওই হেডমাস্টার সঠিক উত্তরটিই দিলেন ‘আমি জানি না’। ব্যস, ওই গ্রামের মানুষের সমস্বরে চিৎকার। স্লোগান। সুবোধ মাস্টার জানে না, জানে না। সুবোধ বাবু তার ব্যাখ্যা দেবার সুযোগও পেলেন না। হারই মানলেন তিনি।

চাতুরি-চালাকিতে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা কঠিন কাজ নয়। ক্ষমতায় থাকায় সরকারকে কারণে-অকারণে ডিস্টার্ব করাও সহজ। আর বিদ্বান-গুণীজনদের নাস্তানাবুদ করা যায় আরেকটু বেশি মাত্রায়। তাকে বা তাদের আনফিট আওয়াজ রটিয়ে মতলব আলী মাস্টারের মতো খুশিতে বগল বাজানো যায়। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান আসে না। সমস্যা আরো জটিল হয়। বিলাপ বাড়ে।

তাই কামনা থাকবে চাতুরি নয়, শক্তিধর দুই দলের মাঝেই নিস্পত্তির মানসিকতা আসুক। সুবোধকে লজ্জিত-অপমানিত করার বাহাদুরি নগদে তৃপ্তি দিতে পারবে। বিজয় দেবে না। নিরাপত্তা-নিশ্চয়তাও দেবে না। বরং চলমান বিলাপ-প্রলাপ আরো ডালপালা ছড়াবে। তা সুস্থ কারো কাম্য হতে পারে না।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর