এরশাদ-ই কী সংশয় দূর করার কবিরাজ
হাওয়া বদল হতে শুরু করলো কী! নির্বাচন নিয়ে দিন কয়েক আগেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনে সংশয় ছিল। সেই তিনি এখন বলছেন নির্বাচন নিয়ে কোন সংশয় নেই। সংশয় কেটে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মন থেকে কী সংশয় দূর হয়েছে? নাকি তাদের মনে নির্বাচন নিয়ে ভয়ের মেঘ জমছে!
শাসক দলের অনেক নেতা বলছেন; ঐক্য ফ্রন্টের নামে ড. কামাল সাহেব নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছেন। পাল্টা দাগতে দেরি করছেন না ফ্রন্ট নেতারা। তারা বলছেন; সরকার নির্বাচন বাতিলে পথ খুঁজছেন! তবে জনগণ বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছেন যখন ফ্রন্ট নেতারা বলছেন; তাদের সাত দফা দাবি না মেনে তফসিল ঘোষণা করা হলে সেটা মেনে নেয়া হবে না। আবার ভোটের আগে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের দাবি; জোট-ফ্রন্ট যাই গড়া হোক, নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানোর ক্ষমতা কারো নেই!
এসব কথা হয়তো ভোটের হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়া কথা। তারপরও বলতে হবে; বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষমতাহীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যাদের শুধু একটা ভোট আছে। সেটা প্রয়োগ করার ক্ষমতা তারা পাবেন, সেই বাতাবরণ তারা দেখতে পাচ্ছেন কী! সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশে ভোট আর ভাতের অধিকারের বহু কথা বলা হয়েছে। বহু নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের সরণিতে পা রাখা আজকের বাংলাদেশে ভাতের অধিকারের শ্লোগান এখন আর কানে বাজে না। কিন্তু ভোটের অধিকার নিয়ে এখন নিউজ প্রিন্টের চেয়ে টেলিভিশনের এয়ার টাইম বেশি খরচ হচ্ছে।
টেলিভিশনের ভোট আড্ডায় নির্বাচন নিয়ে যা বলা হয়; তাতে মনে হয় এদেশে একমাত্র সমস্যার নাম ভোট। আর কোন সমস্যা এদেশে নেই। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশ সফর করে দেশে ফিরে এসে বার বার যে সংবাদ সম্মেলন করছেন, সেখানেও সেই সব ইস্যু নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। আছে নির্বাচন, জোট আর ভোট নিয়ে প্রশ্ন!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনত্যম লক্ষ্যবিন্দু ছিল গণতন্ত্র। নির্বাচন। বা ভোট। কিন্তু এতো বছরেও কী আমরা সেই লক্ষ্যবিন্দু ছুঁতে পেরেছি? রাজনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন না; হ্যাঁ, ছুঁতে পেরেছি। অথচ ভোটের জন্য এদেশের মানুষকে অনেক আন্দোলন –সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। সেই রক্ত মাড়িয়ে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন, তারা জগণনের ভোটের কথাটাই ভুলে গেছেন। এই ভুলে যাওয়ার কারণ, নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন। করে যাচ্ছেন। ইতিহাস তাই বলে।
ভোটের আগে প্রধান দুটো দল নিজেদের দাবি করেন, দেশের সবচেয়ে বড় দল। কথাটা অসত্য তা বলা যাবে না। কারণ, তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব সমর্থক আছে। ভোট ব্যাংক আছে। তবে ভোটের গণিতে প্রমাণ হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি দুই দলের কারোই এখন আর এককভাবে নির্বাচনে জয় লাভ করার সামর্থ্য নেই। যদি নির্বাচন হয়! তাই জোট, মহাজোট, ফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্ট অনেক কিছু তাদের গড়তে হয়।
রাজাকারদের দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াত ছাড়া বিএনপি চলতে পারছে না। তারা মুখেও বলতে পারে না, জামায়াতকে ত্যাগ করলো তারা। আবার তাদের ফ্রন্টসঙ্গীরা বলছেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা ছাড়া সবাইকে সঙ্গে চান তারা! ক্ষমতাসীনরা আবার জামায়াত নামক রাজনৈতিক দলটাকে নিষিদ্ধও করে না!
নিবন্ধন বাতিল হয়েছে জামায়াতের এই যুক্তি দিয়ে তারা পার পেতে চান। আবার তারাই বলেন; জামায়াতকে ছাড়া চলতে পারে না বিএনপি। বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা মুখে বলেন তারা। কিন্তু সেই সংবিধানের চেতনা থেকে হাজার মাইল দূরে সরে এসে।
বিএনপি রাজাকারদের ছাড়তে পারেনি এটাই সত্য। এটাই বাস্ততা। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পতিত স্বৈরাচার এরশাদকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মহাজোটের সঙ্গী বানিয়েছে। ক্ষমতার ভাগ দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে এমন একটা ফ্যাক্টর বানানো হয়েছে; যাতে রাজনীতিটাই জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টি ক্ষমতায়ও আছে। বিরোধী দলেও আছে। জাতীয় পার্টিকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় থাকতে হলে আওয়ামী লীগের বরং দুঃখ প্রকাশ করা উচিত, গোটা আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ভুল ছিল! আবার বিএনপি যদি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী দল দাবি করে, তাদেরও স্বীকার করতে হবে জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া তাদের ভুল ছিল। অন্যায় হয়েছিল। রাজনৈতিক অপরাধ করেছিল। কিন্তু ভুল স্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতে নেই।
তবে হ্যাঁ, ড. কামাল হোসেন সাহেবের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে বিএনপি যে ঐক্যফ্রন্টে এসেছে, তাতে এক ধরনের হাওয়া বদলের আভাস। তবে সেখানেও একটা প্রশ্ন। কামাল সাহেব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু সেই সোনার বাংলা গড়ার ভিত হিসেবে যে সংবিধান খানা রচনার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যাদের; কামাল সাহেব তাদের অন্যতম। তিনি কী তাঁর নিজের হাতে লেখা সেই সংবিধানের কথা ভুলে গেছেন! নাকি সেই সময় ভুল লিখেছিলেন?
সংবিধানে ‘গণতন্ত্র’ বড় একটা পিলার। সেই পিলার ধরে নাড়াচাড়া দিয়ে কী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব?
নির্বাচনের জন্য সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ভাল কথা। কিন্তু দেশ চালাবেন কারা? কিছু অনির্বাচিত মানুষ! তাতে কী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগুনো যাবে? বঙ্গবন্ধুর লড়াই সংগ্রাম কী ছিল ভোট ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নাকি মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ড. কামাল সাহেব আওয়ামী লীগের অনেক নেতাদের চেয়ে উত্তরটা ভাল জানেন। নাকি সময়ের সাথে সাথে সঠিক উত্তরটা তিনিও ভুলে গেছেন!
আসলে ভোটের হাওয়ায় অনেকের চিন্তাই এলোমেলো হয়ে গেছে। ড. কামাল সাহেব এখন আর বঙ্গবন্ধুর দল করেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দলই এখন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ থেকে লক্ষ্য মাইল দূরে সরে গেছে। তাই গণতন্ত্রের কথা তারাও ভুলে যান। বিরোধী দলের সাথে আলাপ-আলোচনার কথা উঠলেই তাদের মস্তিষ্ক গরম হয়ে যায়! কিন্তু বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা হওয়ার পরও ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে বহুবার আলোচনা করেছেন।
কারণ, তিনি জানতেন আলোচনার মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে নেয়া হচ্ছে যে কোন গণতান্ত্রিক নেতার বড় যোগ্যতা। সেটা তাঁর ৭ মার্চেও ঐতিহাসিক ভাষণের মাঝেও বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, তিনি যদি একজনও হয়, আমরা তার কথা মেনে নেবো।’ বঙ্গবন্ধ কিন্তু বলেননি; ‘ কিসের আলোচনা? কার সঙ্গে আলোচনা?’
গণতন্ত্রেও পরিসর বাড়াতে আলোচনার দায়টা শাসক দলের সব সময় বেশি থাকে। বড় দল ছোট দলের কথা না ভেবে নির্বাচন নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের সঙ্গেও শাসক দল আলোচনা করতে পারে। যাতে একটা অবাধ-অংশগ্রহণমূলক –সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কারণ, সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা রাজনীতি না করলেও বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাভাবনার স্তর আর কাজকর্মে তাদেরও একটা প্রভাব আছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেও সাধারণ মানুষের মন থেকে নির্বাচন নিয়ে ভয়-সংশয় অনেকাংশে দূর হতে পারে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় দূর করার কবিরাজ হয়ে পড়লে বিপদ। সেটা গণতন্ত্রের জন্য। রাষ্ট্রের জন্য। দেশের মানুষের জন্য।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এইচআর/পিআর