আম-দুধে মিশে যায়, আঁটি গড়াগড়ি খায়
নির্বাচন এলেই বাংলাদেশে জোট, মহাজোট, ঐক্যজোট, যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি নানান বাহারি রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এইসব জোট গঠন প্রক্রিয়ায় নানান নাটকীয়তা হয়। তবে এবারের নাটকীয়তা আগের সব নাটকীয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
একবছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু মজাটা হলো বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী যিনি ছিলেন, সেই অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীই নেই নতুন ঐক্যফ্রন্টে। ৫৪ সালে তখনকার মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর সেই যুক্তফ্রন্ট স্বাধীনতার মাত্র ৬ বছরের মধ্যে উল্টে দিয়েছিল মুসলিম লীগের গদি। সেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী। পিতার সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখতেই হয়তো বি চৌধুরী গঠন করেছিলেন যুক্তফ্রন্ট।
এই ফ্রন্ট গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য এবং জেএসডি। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠনের ঘোষণার দিনে দেশে ছিলেন না ড. কামাল হোসেন। আর কামাল হোসেন ছিলেন না বলে আসেননি কাদের সিদ্দিকীও। তাই বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য ও জেএসডিকে নিয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। পরে ড. কামাল হোসেন আলাদাভাবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নামে সরকার বিরোধী ঐক্য করার উদ্যোগ নেন। দফায় দফায় বৈঠক শেষে যুক্তফ্রন্ট আর ঐক্য প্রক্রিয়া একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়। তাদের প্রাথমিক ঘোষণা ছিল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দলের সাথে তাদের ঐক্য হবে না।
বিএনপি ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে ব্যাকুল থাকলেও জামায়াতকে ছাড়তে রাজি ছিল না। তাদের যুক্তি ছিল জামায়াত তাদের ২০ দলীয় জোটসঙ্গী। কিন্তু তারা ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসবে একা, জোট নিয়ে নয়। কিন্তু এক হাতে ঐক্য, আরেক হাতে জামায়াত- বিএনপির এই দোদুল্যমান অবস্থানে আপত্তি ছিল ঐক্য প্রক্রিয়ার। বৈঠকে বারবার জামায়াতের ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করার অনুরোধ সত্বেও বিএনপির তাদের অবস্থান বদলায়নি। জামায়াতের ব্যাপারে অনড় ছিল বিকল্পধারা।
তাই জামায়াতকে নয়, কৌশলে বিকল্পধারাকেই ঐক্যের বাইরে ঠেলে দেয়া হলো। কৌশলটা খুব ছেলেমানুষি। শনিবার ঐক্যের চূড়ান্ত ঘোষণার আগে বিকেলে বি. চৌধুরী আর ড. কামালের একান্ত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে বি চৌধুরী ড. কামালের বাসায় যান। কিন্তু ড. কামাল নিজে তো বাসায় ছিলেনই না, বাসায় দরজা খোলার মতও কেউ ছিলেন না। একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি ফিরে যান অপমানিত হয়ে। একজন মান-সম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ এরপর নিশ্চয়ই এরপর ঐক্যে যোগ দিতে যাবেন না, যানওনি। আর এটাই বোধহয় চেয়েছিলেন ঐক্যের উদ্যোক্তারা।
ড. কামাল যখন প্রেসক্লাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দিচ্ছেন, বি চৌধুরী তখন বারিধারায় জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে কোনো ঐক্যে তারা থাকবেন না। ঐক্য প্রশ্নে বিকল্পধারার অবস্থান বরাবরই একই- জামায়াত না ছাড়লে বিএনপির সাথে তারা থাকবে না। ড. কামালও শুরুতে এই অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু কেন তিনি অবস্থান বদলে বিএনপির সাথে মিশে গেলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমে-দুধে মিশে গেল; আর বি চৌধুরী আঁটি হয়ে গেলেন।
তবে কেউ ভাববেন না, এই মুহুর্তে আঁটি হয়ে যাওয়া বি চৌধুরী বা তার ওভারস্মার্ট ছেলে মাহি বি চৌধুরীও রাজনীতিতে ধোয়া তুলসি পাতা। আজকে জামায়াতের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থানের কারণে অনেকের ধন্যবাদ পাচ্ছেন বটে, কিন্তু বঙ্গভবন থেকে বের করে দেয়ার আগে এই বিএনপিতে জামায়াতের সাথে ঘর করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হিসেবে বি চৌধুরী বিএনপিকে স্বাধীনতার চেতনার পক্ষের দল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি, তখন নিজামী আর মুজাহিদ দেশের মন্ত্রী ছিল।
বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে কিছুদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বি চৌধুরী। তখন নিজামী-মুজাহিদের সাথে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসতে বি চৌধুরী আপত্তি করেছেন, এমন বদনাম নেই তার। বিএনপিতে থাকার সময় জামায়াত প্রশ্নে কখনো বিপ্লব করেছেন, এমন কথাও শোনা যায়নি। তাই আজ তার জামায়াত বিরোধিতার সাথে আদর্শের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত অন্য কোনো খেলা বা ইঙ্গিতে বি চৌধুরী এবং তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে গেছেন। যদি সত্যিই দেশকে ভালোবাসেন তাহলে আপনার দলের মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানকে আগে সরান। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদরদের পক্ষে যুদ্ধ করা কাউকে পাশে বসিয়ে জামায়াত বিরোধিতা হাস্যকর লাগে। তবুও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি জামায়াতকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করছেন, এটাই বা কম কি? তিনি যদি অতীতের ভুল বুঝে এখন আন্তরিকভাবেই জামায়াতের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান নিয়ে থাকেন, আর কেউ না দিক; আমি অন্তত তার পাশে থাকবো।
তবে ঐক্যে এতদিন মূল প্রশ্ন ছিল জামায়াত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর সেটিও ইস্যু হতে পারতো। ২১ আগস্ট হামলার পর এর বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন ড. কামাল। তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। কিন্তু আজ রায়ের পর সবাই স্পিকটি নট। যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত, সে দলের সাথে ঐক্য করতে একটুও বাধেনি তাদের।
শুরুতে মনে হচ্ছিল বৃহত্তর ঐক্যের জন্য বিএনপি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তৈরি। কিন্তু কৌশলে বিএনপি দুই কূল রক্ষা করেই ঐক্য করতে পারলো। তাদের জামায়াতের ভোট ব্যাংকও অক্ষুন্ন থাকলো, আবার ড. কামালকে সাইনবোর্ড করে নিজেদের ইমেজ পুনরুদ্ধারের পথেও হাঁটতে পারবে তারা। কিন্তু এই আদর্শহীন ঐক্যে ড. কামালের ইমেজ কতটা অক্ষুন্ন থাকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ধরুন, আগামী নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে কোনো একটি আসনে ড. কামাল ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২০ দলীয় জোটের ভোটও তো তিনি পাবেন, মানে জামায়াতের ভোটও। সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে আসা ড. কামালের কেমন লাগবে তখন? তিনি কি বলে দেবেন, জামায়াত যেন তাকে ভোট না দেয়? অবশ্য ড. কামাল ডেভিড বার্গম্যানকে ঘরে ঠাই দিয়ে অনেক আগেই যুদ্ধাপরাধীদের সাথে তার আপোষের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
একটা বিষয় পরিষ্কার, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিছক বর্তমান সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জোট। রব-মান্না এতদিন বি চৌধুরীর সাথে ছিলেন, সুযোগ বুঝে পল্টি মেরে চলে গেলেন ড. কামালের সাথে। এই ফ্রন্টে আছেন আত্মস্বীকৃত অসুস্থ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সুপুত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবাই জানে, ব্যারিস্টার মইনুল থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। আ স ম আব্দুর রব এতদিন বি চৌধুরীর সাথে ছিলেন, এখন ড. কামালের ঘাটে তরী ভিড়িয়েছেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার পর তিনি কট্টর আওয়ামী বিরোধী দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেই কট্টর আওয়ামী বিরোধী রব ৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এখন আবার তিনি কট্টর আওয়ামী বিরোধী। এর আগে এরশাদের করা ৮৮ সালের নির্বাচনে গঠিত সংসদে বাংলাদেশের প্রথম গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণাপত্র পাঠ করা মাহমুদুর রহমান মান্নাও সাতঘাটের জল খাওয়া নেতা।
যদিও ঐক্যফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণ এখন বিএনপির হাতে। তবে কাগজে-কলমে নেতা হলেন ড. কামাল হোসেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আইনজীবীর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান, বঙ্গবন্ধু সরকারের আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামালের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও প্রজ্ঞা কখনো দেশের কাজে লাগেনি। ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ড. কামাল বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধুর একজন সামান্য কর্মী হিসেবে স্বৈরাচারী শক্তির কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা পেয়েছি। তাই কোনো হুমকিকে ভয় করি না। চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারেন। ট্যাংক, গুলি নিয়ে আসতে পারেন; ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে না।' এখানেই আমার একটু সংশয়। ড. কামাল একাত্তরে সাহসের পরিচয় দিতে পারেননি, পঁচাত্তরে পারেননি, ১/১১এর সময় পারেননি। বরং প্রয়োজনের সময় তাকে দেশে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, যাদের পাশে বসিয়ে তিনি নিজেকে ‘বঙ্গবন্ধুর সামান্য কর্মী’ হিসেবে পরিচয় দিলেন; তারা কি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মানেন?
অনেক তর্জন-গর্জন করে আবির্ভূত হওয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বর্তমান অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের কেমন প্রতিরোধ গড়তে পারে; নির্বাচনের আগে ৭ দফা দাবির কয়টি আদায় করতে পারে; তা দেখার জন্য আমি সাগ্রহে অপেক্ষা করছি। একই সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাফল্য কামনা করছি।
এইচআর/জেআইএম