ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মানবিক আকুতি বিশ্বময় : মিলিয়ন পাউন্ড পায়ে ঠেলে প্রতিবাদ

ফারুক যোশী | প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৮

 

ব্যাংসি (Banksy), এর বেশি তাকে কেউ চিনে না। জানিনা পৃথিবীতে মশুর হয়েছে কি তাঁর এই নাম। কিন্তু ব্রিটেনের তরুণদের কাছে এ এক বিস্ময় মাখা নাম। এই ছবিময় দুনিয়ায় একজন ছবিহীন মানুষ তিনি, তার ছবি কেউ দেখে নি। কিন্তু ইনস্টগ্রামে ৪.১ মিলিয়ন মানুষ তাকে ধাওয়া করে, হন্যে হয়ে খোঁজে। গণমাধ্যম এখনও তার ছবি উদ্ধার করতে পারে নি। কারণ এ নাম শুধু ব্রিটেন নয়, পৃথিবীর অসংখ্য তরুণদের জানিয়ে দিয়ে যায়, যুদ্ধ এক উন্মাদনার নাম।

পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জলের মত গড়িয়ে যাওয়া অর্থের ঢলাঢলিকে কিভাবে পা দিয়ে ঠেলতে হয়,তা দেখিয়ে দেয়ার এক মোহ লাগানো নাম ব্যাংসি। প্রথম এই নামটা শোনেছি আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে প্রভা’র কাছ থেকে। সে-ই আমাকে একে একে দেখিয়েছে, তার চিত্রকর্মগুলো কিভাবে যুদ্ধ উন্মাদনার বিপরীতে দাঁড়ায়, প্রচারিত রাজনীতিকে ব্যাংসি কিভাবে ভেংচি কাটেন। বাজার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের যুগের পৃথিবীর তাবৎ রাজনীতিকে দেখেন তিনি মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠিত করার এক সত্য আস্ফালন হিসেবে।

শিশুদের নিয়ে একটা সুন্দর আর নিটোল পৃথিবী তার চিত্রকর্মে (গ্রাফেটি) পরিস্ফুট। যার চিত্রকর্ম শোষকদের শধুই ব্যঙ্গ করে না, ব্রিটেনের হয়ত পৃথিবীর লাখো-কোটি তরুণ উজ্জীবিত হয় যার কাজ দেখে। যে কিশোর-তরুণরা রাজনীতির ধারে কাছে নেই, যে কিশোর-তরুণরা এই বিলাসী দুনিয়ার সব সুযোগ পেয়ে অন্য জীবনকে খুব একটু পাত্তা দেয় না, সেই তারাই ব্যাংসিকে জানে। ব্যাংসি তাদের কাছে এক উজ্জ্বল নাম।

মদ নারী আর জৌলুস যে সমাজের প্রধান এক অনুষঙ্গ, যে সমাজে চিত্রকর্মগুলো পৃথিবীর আদিম এবং চিরন্তন নারী আর যৌনতাকে অনুষঙ্গ করে এগোয়, সেখানেই ব্যাংসি অনন্য এক নাম। ফ্রান্স,বেলজিয়াম, জার্মান, হলান্ড, ব্রিটেন আমেরকিা তথা পশ্চিমা দুনিয়ায় বন্ত্রহীন নারীর ভাস্কর্য চিরচেনা প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার চিত্র যেমন রাস্তায় পর্যটককে কিংবা সাধারণ মানুষদের শুধুই টানে, সেখানেই ব্যাংসি অনন্য সাধারণ কর্ম নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে এনেছেন নতুন এক মাত্রা। দেয়াল লিখন কিংবা দেয়ালে অংকিত চিত্র কর্মগুলো বলতে গেলে অবৈধ, তারপরও কোন কোন জায়গায় নিটোল সুন্দর ওয়াল চিত্র দেখি আমরা।

এই গ্রাফিতিটি বৈধভাবেই আাঁকেন কোন শিল্পী, তবে তা অবশ্যই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কিংবা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষেই হয়ে থাকে। আইনত চিত্রকর্মের জন্যে কোথাও কোন দেয়ালে চিত্র আঁকা যাবে না এই ব্রিটেনে, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কিন্তু তবুও অনেক চিত্রই থাকে। রংবেরং এর লেখা থাকে। ব্রিজের ওয়ালে, কিংবা কোথাও পরিচ্ছন্ন দেয়ালে রাতের আঁধারে কেউ কেউ লিখে যায়। কেউ মনের আনন্দে আঁকে, কেউ ফাজলামি করে। আবার কেউ এখানেই করে প্রতিবাদ, প্রতিবাদে প্রজ্জ্বলিত করে সারা পৃথিবী।

এই জায়গাটাতেই একজন ব্যাংসি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তার প্রতিবাদে জাগিয়ে তুলছেন সারা বিশ্বকে, বিশেষত তরুণরা উজ্জীবিত হচ্ছে। আলোচনায় উঠে আসছেন তিনি এক অনন্য উচ্চতায়। উচ্চারিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন রাস্তায়। তিনি গ্রাফিতি আর্টিস্ট হিসেবেই পরিচিত। তাবৎ বিশ্বের উন্মাদনার বিপরীতে যার অবস্থান, শক্তিমান মানুষগুলোর বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

বিলাসবহুল হোটেল কিংবা মিটিং পয়েন্টে হাজারো-লাখো পাউন্ডের সেমিনার কিংবা সভা করে কিংবা রাস্তায় লাখো মানুষের সমাবেশে তিনি কথা বলেন না। তিনি তার হৃদয়ের কথাগুলো, পৃথিবীর তাবৎ শোষিত আর নির্যাতিত মানুষের কথাগুলো অকাতরে উচ্চারণ করে যান গোপনে, আঁকা-জোকায়। অথচ তার গোপন উচ্চারণগুলো পৃথিবীর দেয়ালগুলো প্রকম্পিত করছে, প্রতিধ্বনি করছে, মৃদু হলেও কম্পন জাগাচ্ছে লাখ লাখ তরুণ হৃদয়ে।

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চারিত জনপ্রিয় শিল্পকর্মটির (পেইন্টিং) নাম মোনালিসা। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির এই পেইন্টিংটির বর্তমান বাজার মূল্য ধরা হয় ৪৫০ মিলয়ন ডলার। এভাবেই যদি আমরা নাম নেই, হয়ত নাম আসবে ভ্যান গগ, উইলিয়াম ডি কুনিং, জর্জিয়া ও কাফি, পাবলো পিকাসোসহ বেশ কিছু নাম।

শিল্পকর্ম নিয়ে যারা ভাবেন, তারাই জানেন এ কর্মটির কি ভাবনা,কি এক্সপ্রেশন। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়, শিল্পকর্মের লুকিয়ে থাকা ভাবনা কিংবা এবস্ট্রাক্ট (বিমূর্ত) বিষয়গুলো শিল্পের বোদ্ধা ছাড়া কেউই হয়ত খুব একটা ধারণায় নিতে পারে না। কিন্তু তবুও সারা বিশ্বেই আলোচিত শিল্পকর্মগুলোর চড়া মূল্য। শিল্পের সাথে সম্পর্কহীন মানুষগুলোও ঐ কর্মগুলো কিনে নেন সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে। কারণ শিল্পের এই বিমূর্ত ধারণাটা সারা বিশ্বেই অহংকারের একটা জায়গা।

এই অহংকার কিংবা শ্লাঘার জন্যেই সারা বিশ্বে এখনও ঐ কর্মগুলো সমানভাবেই জনপ্রিয়। বিখ্যাত শিল্পীদের কর্ম কিনে নিজের দেয়ালে শোভিত করার মাঝে একটা আত্মস্লাঘা আছে। ব্যাংসি এ ব্যাপারটা খুব ভালভাবেই জানেন। একজন ব্যাংসি যে প্রবলভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন। বিশ্ব রাজনীতির এই যে নির্মমতা, যে নির্মমতায় মরছে নারী-পুরুষ, শিশুরা হচ্ছে এতিম। বাজার অর্থনীতির করাল গ্রাসে শিশুরা হয়ে হচ্ছে শোষকদের হাতিয়ার। তাইতো তার বিচারে পঁচা আর জীর্ণতাকে যারা জিইয়ে রাখছে, তাদের প্রতি ফুল উপহার নয়, এদের প্রতি মুখ বেঁধে ফুল ছুঁড়ে মারেন তিনি।

তাঁর শিল্পকর্মে জ্বলে উঠে তুর্কির সাংবাদিক এবং আর্টিস্ট জেলে যাবার পর সেই এক অসহায় তরুণীর চাহনি, মুখের আকুতি। লন্ডনে ২০০২ সালের কোন এক সময় তার একটা স্ট্রিট আর্টে দেখা যায়, হৃদয় আকৃতির একটা বেলুনকে একটা ছোট্ট মেয়ে তার কাছে পেতে চাইছে, আর ক্রমশ কেন যেন ঐ বেলুনটা তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কিংবা বেলুনটা থেকে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। সেই থেকে তাঁর ঐ ‘গার্ল উইথ বেলুন’ সাড়া জাগিয়েছে শান্তিকামী বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মাঝে।

এই কর্মটি নিয়েই তাঁর এক প্রতিবাদ প্রদর্শিত হয়ে গেল সারা বিশ্বে। সম্প্রতি তাঁর ঐ কর্মটির আর্টওয়ার্ক উঠেছিল নিলামে, লন্ডনে। তাঁর অন্যান্য শিল্পকর্মের মত এটিও অত্যন্ত দামী এক শিল্পকর্ম। ধনীদের বিলাসী জীবনের বিলাসী দেয়ালে টাঙ্গিযে রাখার এক বিমূর্ত শিল্প। তাইতো এটির সর্বশেষ দাম যখন উঠে ১.৪ মিলিয়ন ডলার, তখন এই শিল্পকর্মটিা কিনে নেন পৃথিবীর এক সেরা ধনী মানুষ।

ঠিক সেসময়ই এক অদ্ভুদ প্রতিবাদ দেখে সারা বিশ্ব। দামটা নির্ধারিত হবার সাথে সাথে মানুষ দেখে ঐ শিল্পকর্মটা ক্রমশই নিচের দিকে যাচ্ছে, শ্রেডেডে হচ্ছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আগেই প্রতিস্থাপিত একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিন এই পেইন্টিং এর মধ্যে রাখা হয়েছিল এবং বিস্ময়ের সাথে দেখল মানুষ, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এটা কেটে যাচ্ছে, নিচের দিকে পড়ছে।

একটা ফানুসের দাম ১.৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিতে পারে প্রবল প্রভাবশালী মানুষ। একটা শিশুর আকুতি আর চাওয়াকে কিনে নিচ্ছে ১.৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে, অথচ ক্ষুধায়-জ্বরায়-যুদ্ধে মরছে মিলিয়ন মিলিয়ন শিশু সারা বিশ্বে। একটা শিশুর বিমূর্ত ফানুসের জন্যে অর্থ ঢেলে দিতে পারে যে মানুষগুলো, অথচ এদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন মানবিক আবেদন নেই এদের।

সারা বিশ্বের অগণিত তরুণ-তরুণীর বিবেককে ধাক্কা দিয়েছে এ প্রতিবাদ। ব্যাংসি পায়ে ঠেলে দিলেন ১.৪ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ইন্টস্টগ্রামে ৪.১ মিলিয়ন তরুণ ফলোয়ার আবারও নতুন বার্তা পেল, সারা বিশ্বের অগণিত মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ এই বার্তারই প্রতিধ্বনি করছে- এ বার্তা অর্থ আর মোহের বিপরীতে শুধুই মানবতার।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস