‘গরিবের বউ সবার ভাউজ’
রাজনীতিটা আসলে কী? বাংলা ব্যাকরণ মানলে রাজনীতি হলো নীতির রাজা। যেমন রাজহাঁস রাজার হাঁস নয়, হাঁসের রাজা। কিন্তু আমরা ব্যাকরণটাকে একটু উল্টে দিয়েছি, ভুল ব্যাকরণকেই শুদ্ধ বলে মানি। রাজনীতি এখন রাজা হওয়ার নীতি, রাজনীতির মূল লক্ষ্য ক্ষমতা।
রাজনীতি করলে এমপি হওয়া যায়, মন্ত্রী হওয়া যায়, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা যায়। অথচ এই অঞ্চলেও একসময় ব্যাকরণ মেনেই রাজনীতি হতো। বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কারাগারে থেকেছেন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শে পৌঁছানোর জন্য। তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাননি, এ দেশের মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছেনও।
সিপিবিসহ এ অঞ্চলের অনেকগুলো বিভিন্নপন্থি বাম সংগঠনের নেতারা জানেন, এ দেশে কখনো বিপ্লব হবে না, তারা কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেন না। তবুও তো তারা বছরের পর বছর একটি নীতির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাজা হওয়ার জন্য লড়াই করে যাওয়া রাজনীতিবিদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, কমছে নীতির জন্য রাজনীতি করা মানুষের সংখ্যা। এই কথাটাই স্বভাবসুলভ হাস্যরস মিলিয়ে বলেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসা আবদুল হামিদ এমপি হয়েছেন, ডেপুটি স্পিকার হয়েছেন, স্পিকার হয়েছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
২৮ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন, সাথে অচল দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ। ফলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে নেতৃত্বের পাইপলাইন। আর এই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসছেন সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ পেশাজীবীরা। অথচ বাংলাদেশে এখন বেড়ে উঠছে রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম। জিজ্ঞাসা করলেই তারা বলেন, না না, আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। তারা সারাদিন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেন। তাদের দিন কাটে লাইব্রেরিতে। রাজনীতির সংস্রব তারা এড়িয়ে চলেন। জাতির কোনো প্রয়োজনেই তাদের পাওয়া যায় না। তারা মিছিল করেন না, স্লোগান দেন না। তারা বিসিএস দিয়ে মেধার জোরে সরকারি কর্মকর্তা বনে যান। তারা সচিব হন, আইজি হন। আর চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তারা হঠাৎ রাজনীতি সচেতন বনে যান।
দেশের জন্য কাজ করতে রাজনীতিতে নাম লেখান। এখানে একটা বড় অন্যায় হয়। দাপুটে সাবেক সচিব বা পুলিশ কর্মকর্তার কাছে হেরে যান জীবনভর রাজনীতি করে আসা মানুষটি। জয়ের সম্ভাবতা বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ত্যাগী নেতাকে বাদ দিয়ে সাবেক আমলাকে মনোনয়ন দেয়। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। সাবেক আমলা বা পেশাজীবীরা মনোনয়ন পান, এমপি হন, মন্ত্রী হন। এক্ষেত্রে আরেকটা গুরুতর অন্যায় হয়।
রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা আছে এমন আমলারা ক্ষমতায় থাকতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নকাজ করেন। অথচ ঐ এলাকার রাজনীতিবিদ নিয়মিত জনগণের পাশে থেকেও উন্নয়ন প্রশ্নে পিছিয়ে যান। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মনোনয়ন পেয়ে যান সাবেক আমলা। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জয়টাও তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের যে ধারণা, তা এখানে বারবার মার খেয়ে যায়। আমলারা ক্ষমতায় থাকতে মাঠটা এমন অসমতল করে রাখেন, রাজনীতিবিদরা আর তা সমতল করতে পারেন না।
আগে ব্যবসায়ীরা পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে চাঁদা দিতেন। কখনো কখনো তাদের একাধিক দলকেও চাঁদা দিতে হতো। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরাও স্মার্ট হয়ে গেছেন। তারা ভাবছেন, আমি কেন চাঁদা দিয়ে নেতা বানাবো। আমি নিজেই তো নেতা হতে পারি। তাতে চাঁদার টাকাটাও বেঁচে যায়, সরাসরি ক্ষমতার স্বাদও পাওয়া যায়। তাই রাজনীতিতে এখন রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা, আমলা আর ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার।
আবার অনেকে আছেন, ছাত্রজীবন থেকেই মনে মনে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করেন। কিন্তু রাজনীতি করেন না। তারা ব্যবসা করেন। পর্যাপ্ত টাকা সংগ্রহ করে পরে রাজনীতিতে নামেন। কারণ তিনি জানেন দলের জন্য যত ত্যাগই করেন না কেন, টাকা না থাকলে মনোনয়ন পাবেন না, পেলেও পাস করতে পারবেন না। এভাবেই ক্রমশ রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতা চলতে থাকলে একসময় ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানরা আরো পিছিয়ে পড়বেন। সারাজীবন রাজনীতি করেও মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে যাবেন।
একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব দলই এখন প্রার্থী তালিকা তৈরি করছে। রাজনীতি করার সময় সব দলই নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে। কিন্তু মনোনয়ন প্রশ্নে মূল বিবেচনায় আসে জয়ের সম্ভাবনা। কার টাকা বেশি, কার প্রভাব বেশি, কার জনপ্রিয়তা বেশি, কে বেশি উন্নয়ন করেছে- এসবই গুরুত্ব পাবে। এই বিবেচনায় ছিটকে পড়বেন অনেক ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান।
একজন ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান হিসেবে এই প্রবণতা ভালো লাগেনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে এই ক্ষোভের কথাটাই তিনি বলেছেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। একজন রাজনীতিবিদ চাইলে শিক্ষক হতে পারবেন না, ডাক্তার হতে পারবেন না, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবেন না, আইনজীবী হতে পারবেন না। কিন্তু সবাই চাইলে রাজনীতিবিদ হতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতি এই দুঃখটাই বলেছেন, কিশোরগঞ্জের একটি আঞ্চলিক কথা দিয়ে- গরীবের বউ সবার ভাউজ। এটা শুধু কিশোরগঞ্জ নয়, কুমিল্লায়ও আমরা শুনেছি। তবে অনেকদিন পর কারো মুখে কথাটি শুনলাম। গরীবের বউকে সবাই ভাবি মনে করে, সুযোগ নিতে চায়। রাজনীতিও যেন এখন গরিবের বউ, সবাই সুযোগ নিতে চায়।
এই প্রবণতা রোধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, মেধাবীদেরর রাজনীতিতে উৎসাহিত করা। রাজনীতিবিমুখ তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী করা। সবাইকে বোঝাতে হবে, রাজনীতি মানেই খারাপ নয়। দেশ ও জনগণের সেবার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রাজনীতি। তবে লেখাপড়া বাদ দিয়ে খালি রাজনীতি করলে হবে না। কারণ এমপি হতে হলে, মন্ত্রী হতে হলে খালি সারাজীবন রাজনীতি করলেই হবে না। সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়নের, মন্ত্রণালয় চালানোর যোগ্যতা থাকতে হবে।
মন্ত্রী যোগ্য না হলে, আমলানির্ভর হতে হয় তাকে। ব্যাপারটা যদি এমন হয়, ক্লাশের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি সচিব হলো, আর ক্লাশের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটি রাজনীতি করে করে সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়ে গেল; তাহলে কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হবে না। আমলারাই মন্ত্রণালয় চালাবে, অবসর নিয়ে রাজনীতিও করবে। তবে রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে, ডাকসুসহ সকল সকল ছাত্র সংসদে নিয়মিত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ছাত্রনেতাদের দেশ পরিচালনায় যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। মনোনয়ন দেয়ার সময় রিটায়ার্ড মৌসুমী পাখিদের নয়, রাজনীতিদদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সাবেক আমলা বা পেশাজীবীরা যদি তাদের অভিজ্ঞতা দেশের জন্য কাজে লাগাতে চান, তবে দলের উপদেষ্টা পরিষদে তাদের অন্তর্ভুক্তি বা টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রীও করা যেতে পারে। রাজনীতি যেন রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকে।
৭ অক্টোবর, ২০১৮
এইচআর/জেআইএম