বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ
নির্বাচনকে যদি গণতন্ত্রের একটি পথ বলে ধরা হয় তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পথটি কখনোই সুগম ছিল না। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর সেনা শাসনগুলোতে নির্বাচন হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ প্রহসনমূলক এবং নির্বাচন ব্যবস্থাটিকে করে তোলা হয়েছিল হাস্যকর রকমের ঘটনা হিসেবে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রের টাকা আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে বাংলাদেশে গঠন করা হয়েছিল দু’টি বড় রাজনৈতিক দল।
কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের গঠন প্রক্রিয়ার ভেতরই যদি স্বৈরতান্ত্রিক জটিলতা থেকে যায় তাহলে তারা যে পরবর্তীতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করতে পারে না তা বাংলাদেশে প্রমাণ হয়েছে। ১৯৯০ সালে এক স্বৈরাচারের আমলে সৃষ্ট রাজনৈতিক দল আরেক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান চেয়েছে স্বার্থগত কারণে, কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য নয়।
এটা একারণেই বলা যে, যদি তাই-ই হতো তাহলে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার আগে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেন বিএনপি ব্যর্থ হয়েছিল, সে প্রশ্ন অত্যন্ত যৌক্তিক হয়ে পড়ে।
আমরা সে প্রশ্নের উত্তর পাই এভাবে যে, ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয় যাতে বাংলাদেশের মূলধারার কোনো দল এমনকি আরেক স্বৈরাচারের হাতে গড়া রাজনৈতিক দলটিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আন্দোলনের মাধ্যমে ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গঠিত সরকারকে বাধ্য করা হয় একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করতে এবং তার অধীনেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে।
অর্থাৎ নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করণে বাংলাদেশে নতুন করে আন্দোলন করতে হয় ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার-মুক্ত হওয়ার পরও। অথচ তখনই যদি নির্বাচন ব্যবস্থাটিকে সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে রাখা সম্ভব হতো তাহলে আজকেও হয়তো আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো না আমাদের।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং পাঁচ বছর পর সংবিধানে বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইতিহাস সৃষ্টি করে, কারণ এর আগে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো ইতিহাস না বাংলাদেশে না যে দেশটি থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল সেই পাকিস্তানে ছিল।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো যে, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সম্পূর্ণ ভাবে দলীয় সরকারের মতোই একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করলো। আওয়ামী লীগ পরাজিত হলো। আর পরাজয়ের মূল্য হিসেবে দেশে রক্তগঙ্গা বইলো। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রাণ দিলো, নারীরা দিলো সম্ভ্রম আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া হলো।
২০০১ সালে বিজয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াত সরকার সারা দেশকে একটি ভয়ঙ্কর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল যেখানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর কেবল গ্রেনেড হামলা নয়, একের পর এক জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে সেই সময়। সারা দেশে একযোগে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এবং বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
আবারও গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে এ সময়ে, কারণ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে এই সময়ে হওয়া কয়েকটি উপ-নির্বাচনের কারণে। শুধু জালভোট নয়, নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সকল পদ্ধতি প্রকাশ্যেই এসব নির্বাচনে অনুসৃত হয়। কেউ বাধা দেওয়ার ছিল না কেবল তাই-ই নয়, ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে আবারও সেই সেনা শাসনামলের হ্যাঁ-না ভোটের আদলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
প্রায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটার যুক্ত করা হয় ভোটার তালিকাতে। ফলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে এই দোষত্রুটি মুক্ত করার জন্য নতুন আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সংবিধানে সংযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেও বিতর্কিত করে ফেলা হয় একজন দলীয় ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি করার জন্য তার বয়স পরিবর্তন করানোর মাধ্যমে। একটি দেশের সংবিধানকে এতোটা খেলো ও ন্যক্কারজনক ভাবে নোংরা করার উদাহরণ আর পাওয়া যাবে না।
ঠিক এই সময়েই আমরা লক্ষ্য করলাম যে, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং জঙ্গীমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য আন্দোলনরত আওয়ামী লীগকে মিলিয়ে ফেলা হলো বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যারা অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের দলীয় রাষ্ট্রপতিকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবেও রেখে দিলো। আর এই মিলিয়ে ফেলার কাজটি করলেন তারাই যারা মূলতঃ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলা, যাদেরকে অনায়াসে সুশীল সমাজ বলে চিহ্নিত করা যেতো যদি না তারা দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ না করতেন।
বিদেশি দূতাবাসগুলোও এসময় তৎপর হয়ে উঠলো একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য। সংবিধান রহিত হলো, এবং বলা হলো যে, এটা ডকট্রিন অব নেসেসিটি। দু’টি বছরের জন্য বাংলাদেশ আবার ফিরে গেলো অনির্বাচিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। তারা দেশ পরিচালনার বাইরেও এমন সব কাজ করতে শুরু করলো যার এখতিয়ার তাদের ছিল না।
মানুষ আবারও ভীত হয়ে পড়লো তাদের গণতান্ত্রিক, সামাজিক অধিকার নিয়ে এবং সর্বোপরি মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বন্দী করা হলো, দেওয়া হলো অজস্র মামলা। কিন্তু শেষ অবধি তাদেরকেও সরতে হলো জনগণেরই চাপে। নির্বাচন দিতে হলো, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব তারা পেতেই পারেন।
নতুন সরকার গঠিত হলো ২০০৮ সালের শেষভাগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর। নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে এতো তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এই সরকারের সামনে কোনো নতুন পথ খোলা ছিল কি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা ছাড়া? কারণ একবার নয়, দু’দু’বার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে তখন আর তার ওপর নতুন করে আস্থা রাখা কী সম্ভব ছিল?
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নয় আদালতের নির্দেশেই এই পদ্ধতি বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে যখন আরেকটি নির্বাচনের মুখোমুখি দেশ তখন সারা দেশে যে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব শুরু হয় নির্বাচন প্রতিহত করার তাতে মানুষ আবার ভীত হয়ে ওঠে তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য।
গণতন্ত্র তখন আর মুখ্য বিষয় থাকে না মানুষের কাছে। একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তাতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ও তার শরীক দলগুলি অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় ঠিকই কিন্তু মানুষ সরকারকে মেনে নেয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক বিপরযয় ঘটেনি যদিও চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার, সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য। অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়া সরকার এখন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দ্বারপ্রান্তে।
আবারও সেই আশঙ্কা আর ভয় সকলের মধ্যে কাজ করছে, কী হবে শেষ অবধি? নির্বাচন হবে তো? বিএনপি আসবেতো নির্বাচনে? যদি নির্বাচন হয় ও সরকার বদলায় তাহলে ২০০১ সালের মতো নতুন করে রক্তস্রোতে ভাসবে নাতো বাংলাদেশ? নাকি ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে আবারও টিকে যেতে পারবে সরকার? আর নির্বাচন যাতে ঠেকানো যায় বা সরকারকে যাতে ক্ষমতা থেকে নামানো যায় সে লক্ষ্যে নতুন করে শুরু হবে আগুন-সন্ত্রাস? এরকম বহু প্রশ্ন নিয়ে সাধারণ মানুষ এই মুহূর্তে একটা ভয়ঙ্কর ভীতির মধ্যে বসবাস করছে।
এই ভীতি থেকে মানুষকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে গণতন্ত্র, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু এদেশে গণতন্ত্র যে মহামূল্যবান এবং সেই মূল্য যে মানুষকে জীবন দিয়েই চুকাতে হয় সেটাও এদেশের মানুষ জানে। আর জানে বলেই মানুষ এখন শঙ্কিত দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। এর মধ্যে যখন বিদেশীদেরকে দেশী রাজনীতির অংশীজন করে তোলার জন্য কোনো কোনো পক্ষ উতলা হয়ে ওঠে তখন এই শঙ্কা আরো তীব্র হয়। কারণ, বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বিদেশিরাও কড়া মূল্যমান হেঁকে থাকেন বলে প্রমাণ রয়েছে।
ওয়ারউইকশায়ার ১ অক্টোবর, সোমবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম