দেশপ্রেম বনাম বিদেশপ্রেম
একবার উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য দেশের বাইরে অর্থাৎ উন্নত দেশে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলাম। কিন্তু যতবারই ভেবেছি ততবারই বুকের ভেতর হু হু করে উঠেছে। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠতো, আমার কি বাইরে যাওয়ার জন্য সাহস কম নাকি দেশের প্রতি প্রেম বেশি?
ছোটবেলা থেকেই কত দেশের গান, নাটক, সিনেমা দেখে দেখে বড় হয়েছি। দেশের প্রতি প্রেম বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একবার আমার এক আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা কত মানুষ আছে তারা উন্নত দেশের সিটিজেনশিপ পেতে চায়, আমার কেন ইচ্ছে হয় না? তিনি তখন আমাকে হাতির গল্প শুনিয়েছিলেন।
হাতির বাচ্চাকে ছোট থেকেই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। হাতির গায়ে এত শক্তি যে বড় হলে সে সামান্য শিকল ছিড়ে অনায়াসেই মুক্ত হয়ে একি ওদিক ছুটে চলে যেতে পারে। কিন্তু সে চেষ্টা করে না, কারণ সে বিশ্বাস করে শিকলে বন্দি জীবনই তার আসল জীবন। আমি ভাবলাম আমার এই দেশে থাকা কি হাতির শিকলে বন্দি থাকার মত বিশ্বাস, অভ্যস্ততা নাকি প্রেম? আমার মত দেশে থাকা আরও অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগতে পারে।
আমার এক বন্ধু কানাডা প্রবাসী। তিনি সেখানে বাড়ি করেছেন। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকেন। মাসে ছয় লাখ টাকা আয় করেন। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কানাডা থাকতে কেমন লাগে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, কানাডা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও নিরাপদ দেশ। কানাডা সরকার আমাকে একটা ভাল চাকরি দিয়েছে, আমি সব মিলে খুব সুখী। তবে আমার দুই বছরে একবার দেশে যেতে না পারলে অস্থির লাগে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক উনি আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। প্রতিবছর একবার করে দেশে আসেন। ওনাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, আপনি কেন আমেরিকায় থেকে গেলেন? আপনার মত মেধাবীরা সবাই যদি দেশ ছেড়ে চলে যায় তবে দেশের কী হবে?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশের অস্থির রাজনীতি, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এসবের সাথে আমি তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি, তাছাড়া দেশে থেকে ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হতো সব মিলিয়েই আমেরিকা থাকা। তাছাড়া, আমি তো আমার দায়িত্ব থেকে সরে যাইনি, প্রতিবছর দেশে এসে ছেলেমেয়েদের সেমিনারের মাধ্যমে যতটুকু পারি মোটিভেট করি।
আমাদের দেশে এমন মানুষও আছে যারা মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের গল্প বলে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলাকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করে। যাতে বড় হয়ে তারা দুর্নীতি করার পরিবর্তে দেশের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ হয়। দেশে, সমাজ রক্ষায় তারা যেন মরিয়া হয়ে ওঠে।
অপরদিকে এমন মানুষও আছে যারা দেশপ্রেমের নাম করে রাজনীতিতে ঢুকে নিজের আখের গোছাতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এরটা ধরে ওরটা মারে, সে এক করুণ অবস্থা। আমাদের দেশের কিছু মানুষ নিজেদেরকে ভাল রাখার জন্য একটা বিশাল জনগোষ্ঠিকে যে বঞ্চিত করছে, প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা সেটা বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছে না। কারণ পেটের ভাত জোটাতে গিয়ে তারাও আজ জীবনের কাছে বন্দী।
টিভি ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের একটা বক্তব্য সেদিন ইউটিউবে শুনলাম, তিনি বলেছিলেন অনেকবারই আমার সুযোগ এসেছে দেশের বাইরে যাওয়ার কিন্তু আমি যাইনি। ভেবেছি আমার কথা ও কাজ দিয়ে যদি মানুষের মনে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম জাগাতে পারি আমার জন্ম সার্থক হবে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, যারা দেশের বাইরে ভাল অবস্থানে আছে, ভাল আয় করছে, তাদের আয়ের শতকরা তিন ভাগ যদি দেশের কাজে ব্যয় করে তবে তাদের দেশের প্রতি কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করা হবে।
প্রথমত একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে, যার ভেতরে থাকবে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম সেভাবে গড়ে তুলতে হলে এদেশের শিক্ষা গ্রহণ করার পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত সমাজ ও রাজনীতিতে পরিশুদ্ধির প্রয়োজন। যাতে এই সমাজে মানুষ স্বাধীনভাবে ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে এবং শুদ্ধ রাজনীতির চর্চায় মেধাবীরা যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তবেই দেশ আগাবে, দেশের মানুষ দেশেই থাকতে চাইবে।
তখন মানুষ আবারো সমস্বরে গেয়ে উঠবে- “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”।
লেখক : গবেষক।
এইচআর/জেআইএম