ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ১০:২৮ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা আমাদের দেশের গবেষণা নিয়ে গর্বিত হওয়ার মতো অন্তত তিনটি উপলক্ষ পেলাম। এগুলো হচ্ছে ইলিশের জিনোম আবিষ্কার, ক্যান্সার সনাক্তকরণের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং সর্বশেষ যক্ষাজীবাণু প্রতিরোধী ওষুধের ব্যবহারে পুরোনো ওষুধসমূহের নতুন মাত্রায় ব্যবহার। সর্বশেষ এ আবিষ্কারটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলাদেশের মুখ অনেকটা উজ্জ্বল করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এ আবিষ্কারকে স্বীকৃতিও দিয়েছে।

জিনোম আবিষ্কারের সাফল্য অবশ্য শুরু হয়েছে প্রয়াত প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জনাব মাকসুদুল আলম সাহেবের হাত ধরে। উনি ২০১০ সালে পাটের জিনোম আবিষ্কার করেছিলেন। জিনেটিক্স বিজ্ঞানে সেই আমাদের সাফল্যের শুরু। সামনে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও জিনেটিক্স নিয়ে হয়ত জোরদার গবেষণা আমাদের দেশে শুরু হবে। আশা করি সেখানেও আমরা বিশ্বকে আমাদের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারব।

শুধুমাত্র অন্যদের কাছ থেকে নেয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের ভেতরে চালু ছিলো সে অচলয়াতন এখন ভাঙতে শুরু করছে। এটা প্রচণ্ডরকম আশাবাদী হওয়ার বিষয়।যারা গবেষণাকাজে তাদের মেধা, শ্রম, মনন দিয়ে পুরো পৃথিবীর কল্যাণে নিয়োজিত তাদেরকে অভিনন্দন। কারণ তাদের এ জ্ঞানছাড়া পৃথিবী আমাদের জন্য বিপদসঙ্কুলই থেকে যেতো। মানবজাতির সামনে এগোনের পথ দুরুহ হয়ে পড়তো। আমরা এ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য যে লড়াই; সেটা করতে পারছি এ গবেষণা জ্ঞানের জন্যই।

এই যে তিনটি আবিষ্কার সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সেটা নবীন গবেষকদের জন্য উৎসাহের বিষয়। যারা ধারণা করতো আমাদের দেশে গবেষণা করার মোটেই পরিবেশ নেই—এ আবিষ্কার তাদের সে ধারণাকে কিছুটা হলেও পাল্টে দিতে পারবে বলে আমার মনে হয়। ফলে আগামীতে যারা বিদেশে গিয়ে গবেষণাকাজে মন দিতে সচেষ্ট আছেন তারা হয়ত দেশেই তেমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। আমার মনে হয় এ আবিষ্কারসমূহের প্রায়োগিক যে দিক নিয়ে এতটা হৈ চৈ হচ্ছে তার আড়ালে নতুন গবেষকদের দেশে গবেষণা কাজে নিয়োজিত হওয়ার যে তাড়না এসব আবিষ্কারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সেটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তরুণরা যদি দেশে থেকেই গবেষণা করতে পারে তাহলে দেশের অগ্রগতি, উন্নয়নে এবং সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এজন্য এখন থেকেই সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উচিত গবেষণাকাজে বেশি বেশি সাহায্য সহযোগিতা করা যাতে তরুণরা উৎসাহিত হয়। দেশেই যেন তারা নিত্য নতুন গবেষণা কাজে মন দিতে পারে। বিদেশে এই যে স্কলারশিপ দেয়া হয় এটা কিন্তু শুধু সেদেশের সরকার দেয় না।

বরং অনেক বড় বড় ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এসব কাজে ভালোরকম আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে। যা দিয়ে গবেষণাকাজ সুন্দরমতো এগিয়ে যায়। সেখানে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা থাকলেও গবেষণাকাজে তাদের অর্থ দিতে তেমন একটা চিত্তবান মনে হয় না। এখানেই আমরা পিছিয়ে আছি। আশাকরি এখন থেকে আমাদের দেশের বিত্তবানরা একাজে এগিয়ে আসবেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানও তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে।

সর্বশেষ যে যক্ষা ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু নিয়ে বাংলাদেশের গবেষণা সাফল্যে সারাবিশ্ব উপকৃত হলো তার উপরে দুকথা লিখতে চাই। একটা সময় ছিলো যখন বলা হতো “যার হয়েছে যক্ষা / তার নেই রক্ষা”। এটা এমনি এমনি কিন্তু বলা হতো না। কারণ যক্ষা হলে তখন চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মানুষ ধুকে ধুকে মারা যেতো।

তারপর যখন এর জীবাণু আবিষ্কৃত হলো- মানে এক ধরনের মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়াই যে এ রোগের জন্য দায়ী সেটা জানা গেলো এবং তার বিরুদ্ধে ওষুধ আবিষ্কার হলো তখন তার প্রয়োগে যক্ষা নিরাময় হওয়া শুরু হলো। যক্ষাজনিত মৃত্যু সেই থেকে পুরোপুরি প্রায় রুখে দেয়া গেলো। এর সাথে শুরু হলো ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম। ফলে চিকিৎসার পাশাপাশি যক্ষা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডও জোরদারও হলো।

এরই এক অবস্থায় দেখা গেলো যক্ষার ওষুধ পুরো মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় অবধি প্রয়োগ করলেও যক্ষা নির্মূল হচ্ছে না। সব থেকে কম সময় ৬ মাস অবধি যক্ষার ওষুধ খেতে হয়। তবে, অবস্থাভেদে এ সময় কিন্তু বাড়তে পারে। ঐ যে বললাম ৬ মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার পরেও যক্ষা কেন ভালো হচ্ছে না—সেটার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো যে যক্ষার জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এর মানে ওষুধ এখন আর যক্ষার জীবাণুকে মারতে পারছে না। এটা জানার পরে গবেষক, চিকিৎসক, রোগী সবার কপালে ভাঁজ পড়লো।

কী করা যায় তাহলে! সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যক্ষার জন্য প্রয়োগকৃত ওষুধ তখন ২ বছর মেয়াদে ব্যবহারের নতুন নির্দেশনা দেয়া হলো।এতদিন সেভা্বেই চলে আসছিলো। তবে, সম্প্রতি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষার চিকিৎসায় বাংলাদেশের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ২৪ মাসের পরিবর্তে মাত্র ৯ মাস ওষুধ খেলেই রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভবপর হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের নতুন গাইডলাইনে আমাদের উদ্ধাবিত এ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষার চিকিৎসায় সময় যেমন কমবে তেমনিভাবে আর্থিক খরচও বহুলাংশে কমবে। আর দীর্ঘসময়ব্যাপী যক্ষার ওষুধ খাওয়ার যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সেটাও অনেক কমবে।

এসব আবিষ্কারই এখন আমাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। শুধু প্রয়োজন গবেষণাক্ষেত্র নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা। তাহলেই আশা করি কাজের কাজটুকু হয়ে যাবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন