মনোজগতে উপনিবেশ
শেষ পর্যন্ত খুব তাড়াহুড়া করেই বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস করে নিল সরকার। সাংবাদিক ও মিডিয়া বিষয়ক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ ছিল, উদ্বেগ ছিল। কিন্তু কোন কিছুই আর আমলে নেয়া হয়নি। অথচ আইনমন্ত্রী সম্পাদক পরিষদ, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এটকো এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে বৈঠক করে মতামত নিয়েছেন।
সংসদীয় কমিটিও বসেছিল এবং কথা ছিল আরও একটি বৈঠক হবে। চূড়ান্ত ওই রিপোর্টে খসড়া আইন (ড্রাফট অ্যাক্ট)-এর ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এই অনুচ্ছেদগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে বলেই সাংবাদিক সমাজ মনে করছে।
একদিকে বর্তমান সরকার নিজেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছে, এই আইনের অধীনে তথ্য অধিকার আইনকে অন্তর্ভুক্ত করছে, আবার সেই বৃটিশ যুগের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট- ১৯২৩কে যুক্ত করেছে। এটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সুস্পষ্ট সাংঘর্ষিক। তার অর্থ হল, ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ভঙ্গ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার সাজা হবে।
এর সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড। এর মাধ্যমে আমলাতন্ত্র মূলত আবার সেই পুরোনো সংস্কৃতিতে ফেরত গেল, যেন নিজেদের সব দুর্নীতি চাপা থেকে যায়। দুঃখজনক হলো, এমন একটি ব্যবস্থা ফেরত এলো কোন অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের আমলে নয়, আওয়ামী লীগের মতো একটি গণভিত্তিক রাজনৈতিক দলের শাসনামলে। দেশ এগুচ্ছে বলে দাবি করছি, কিন্তু নীতি নির্ধারকদের মনোজগতে উপনিবেশ স্থায়ীভাবে বাস করছে।
আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাকে নতুই আইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে ৫৭ ধারা আর নেই। এই ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ যুক্ত করে মূলত গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ জনগণের তথ্য অধিকারকে হরণ করে নেয়ার ব্যবস্থা হলো কিনা, এমন একটা ভয় কাজ করছে গণমাধ্যম কর্মীদের ভেতর। এই আইনে যেভাবে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে সাংবাদিকতা করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও ভাবা দরকার। সাংবাদিকরা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা একটি ডিজিটাল আইন চান। কিন্তু আইনটি পাস হওয়ায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে, সাংবাদিকদের এমন উদ্বেগ দূর করার দায়িত্ব সরকারের।
এই আইন মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছে। শুধু যে মুক্ত সাংবাদিকতার জন্যই আইনটি একটি খড়গ তাই নয়, একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রেও এই আইন কতটা বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলছে। সভ্যতা এগিয়ে গেছে, প্রচলিত ধারণাকে সমালোচনা করেই। যেকোনো বিষয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে।
সভ্য সমাজ ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারই শুধু দেয় না, প্রকাশের অনুকূল পরিবেশও তৈরি করে দেয়। ইতিহাস হোক, রাজনীতি হোক, ধর্মীয় বিষয় হোক, যুক্তিযুক্ত মতবাদ প্রকাশের অধিকার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। এই আইনটি স্বাধীন গবেষণার ক্ষেত্রে, মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর বাধা।
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার। অথচ এমন একটি আইন হয়েছে, যা ডিজিটচাল বাংলাদেশকে নিয়ে গেল ১৯২৩ সালে। নিরাপত্তার নামে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলো কিনা সেটা ভাবা হয়নি।
স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের পরিবেশ খর্ব হলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। স্বল্প মেয়াদে সুবিধা অর্জনের জন্য সরকার যদি করে তাকে, তাহলে বলতেই হবে দূরদর্শীতার অভাব ছিল। আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী একাধিকবার সাংবাদিকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ৩২ ধারা বাদ দেওয়ার কথাও বলেন।
আইনমন্ত্রী স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যমবিরোধী কোনো কিছু থাকলে তা বাদ দেওয়া হবে।’ অথচ আমরা দেখলাম জনগণের তথ্য পাওয়ার আইনকে পেছনে ঠেলে সামনে নিয়ে আসা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-কে। সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, কমছে সাংবাদিকের স্বাধীনতা। স্বাধীন সাংবাদিকতার সূচকে আমরা কেবল পিছিয়েই যাচ্ছি। এমতাবস্থায় এই নতুন আইন আমাদের আরও ভীত করে তোলে।
এই আইনটি মানুষের অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আরো নমনীয় করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আইনটি সরকারের সমালোচনাকারীদের অথবা ভিন্নমত পোষণকারীদের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।
অতীতে দেখা গেছে যে সরকারই নিবর্তনমূলক আইন করেছে একসময় সেই আইন তাদের জীবনকেই দুর্বিষহ করে তুলেছে। আমাদের দেশের যে সংস্কৃতি তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের বিবেক দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। সুতরাং এই আইনটি প্রয়োগের ব্যাপারে কতটা সতর্কতা থাকবে সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস