ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জিপিএ-ফাইটাররা কুপোকাত

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এবার প্রাইভেট বিশ্বিদ্যালয়ের বাজার আরো জমবে। তা জানতে-বুঝতে গণক হওয়া জরুরি নয়। গুজব বা গায়েবি কিছুতে ভর করার দরকার নেই। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বাজার গরম হওয়ার আভাসটি নিশ্চিৎ হওয়া গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটে ভর্তির ফলাফলে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ- ইউনিটে এবার পাসের হার ১০.৯৮। আর ফেলের হার ৮৯-এরও বেশি। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ গ-ইউনিট দিয়েই এবার ভর্তি যুদ্ধ শুরু হয় প্রাশ্চ্যের এই অক্সফোর্ডে। ইউনিটটিতে ১২৫০টি আসনের বিপরীতে এবার ভর্তিচ্ছু ছিল ২৬ হাজার ৯৬০জন। অর্থাৎ প্রতি আসনে ফাইটার ২১ জন। এ ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে দুই হাজার ৮৫০ ছাত্রছাত্রী। ফেল ২৩ হাজার দুজন। শতকরা হিসাবে ৮৯%। ৯৮ ভাগ পাসের রাজ্যে ৮৯ ফেলের এ নমুনা কী বার্তা দিচ্ছে?

এটি ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের সামগ্রিক চিত্র নয়। খণ্ডিত চিত্র। কিন্তু খণ্ডিত হলেও বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যান্য ইউনিটের পরিসংখ্যান কম-বেশি এমনই। ফলাফলটি বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতাটি আসলেই যুদ্ধের চেয়েও বেশি। এখানে সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ভর্তিযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের সংখ্যা পূর্বনির্ধারিত। জানার বাকি থাকে শুধু নামগুলো। তাই বলে একেবারে ফেল বা অকৃতকার্য হবে তারা? এ যোদ্ধারা সবাই মেধাবী। জিপিএ-ফাইভ অনেকে। গোল্ডেনও রয়েছে। তারা গণহারের কাছাকাছি ৮৯ ভাগই ফেল করবে?

ভর্তি অফিসের তথ্য থেকে জানা যায়, এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটে সাত হাজার ১২৮ আসনে প্রার্থী দুই লাখ ৭২ হাজার ৫১২ জন। এই হিসাবে প্রতি আসনে কেনডিডেট ৩৮ জন। বরাবরের মতো এবারও সর্বাধিক আবেদন পড়েছে সম্মিলিত ঘ-ইউনিটে। আর সর্বনিম্ন চ-ইউনিট কারু ও চারুকলায়। এবার ক-ইউনিট মোট আসন এক হাজার ৭৫০টি। এর আবেদনকারী ৮২ হাজার ৯৭০ জন। খ-ইউনিটে আসন দুই হাজার ৩৭৮টি। এর জন্য আবেদন করেছে ৩৬ হাজার ২৫০ জন। গ-ইউনিটে ১২৫০টি আসনের বিপরীতে আবেদন করেছে ২৭ হাজার ৫৩৪ জন। ঘ-ইউনিটের এক হাজার ৬১৫টি আসনের বিপরীতে প্রার্থী এক লাখ ৬১৪ জন। চ-ইউনিটে ১৩৫টি আসনের বিপরীতে আবেদনকারী ২৫ হাজার ১৪৪ জন।

শুধু ভর্তি পরীক্ষায় পাস-ফেল নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় কামিয়াবির সংখ্যা কম হবে এটাও স্বাভাবিক । নির্দিষ্ট আসনের জন্য শিক্ষার্থী বাছাইতে অনেকে বাদ পড়বেই। কিন্তু মেধাবীরা ফেল করবে কেন? নামিদামী স্কুল, কলেজ, কোচিং, জিপিএ ফাইভ কি ফেলনা? এতো অর্জনের পর তারা বকলম হয়ে গেল? পাস মার্কসও পাবে না? অবাক-বিস্ময়ের সঙ্গে তা কিন্তু হাসির জোগানও দিচ্ছে। অনেকে ভর্তি এবং চাকরি পরীক্ষায় পাস-ফেল আলাদা করার বিপক্ষে। কারণ এ দুই পরীক্ষায় মার্কসশিট নেই। সনদও নেই। বাস্তবতাদৃষ্টে যুক্তি বড় কড়া। কিন্তু এ যুক্তিতে মুক্তির দিশা নেই।

শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান এই জিপিএ নিয়ে হতাশা-ক্ষোভের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফলের এ চিত্র। বিভিন্ন মহল থেকে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবেই আমাদের একটি প্রজন্মকে নষ্ট করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারলে একটি জাতি আর সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেই টার্গেটে শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষার্থী করে ফেলা হয়েছে। তাদের ভাণ্ডারে বেশুমার সোনালী-রূপালি জিপিএ।

সার্টিফিকেটের পর সার্টিফিকেট। লাখ লাখ টাকায় গোল্ডেন, সিলভার, ডায়মন্ড জিপিএ সনদ হাতানোর দুঃখজনক খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এগুলোতে অভিজাতদের আভিজাত্য বা স্ট্যাটাস আরো বাড়ে। এই সনদে বাজারে ছুটাছুটিতেও অন্যরকমের ফিলিংস। প্রতিবেশিদের কাছে আলাদা কদর, সমীহ মেলে। এ জিপিএ নিয়ে বিদেশেও ছুটছে সামর্থবানরা। বিদেশে বাড়ি- গাড়ি, ডলার-পাউন্ডে টইটুম্বুর হচ্ছে তারা। অবচেতনেই তারা বলেও বসে- কি অসভ্য, নোংরা আর গর্দভদের দেশেই না এতদিন ছিলাম। কোনো দেশ বা জাতিকে ধ্বংসের জন্য তা যথেষ্ট।

কেউ গোল্ডেন পেয়েছে শুনলে বোধজ্ঞানের মানুষের মধ্যে ওই শিক্ষার্থীর জন্য শঙ্কা তৈরি হয়। চোখের সামনে ভাসে-এই রেজাল্টের জন্যে তাকে কতো না কষ্ট-ঝামেলা সইতে হয়েছে? বাবা মা নিশ্চয়ই তাকে অনেক কোচিং-প্রাইভেটে টানাহ্যাচড়া করেছে। হতে পারে পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার প্রশ্ন আউট করে বাচ্চাটিকে দিয়ে মুখস্থও করিয়েছে।

পরীক্ষা একটু খারাপ হলে না জানি তার বাবা মা তাকে কতো বকাঝকা করেছে। জিপিএ নিশ্চিৎ করতে গিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সিলেবাসের বাইরে পড়তে দেনও না। সন্তানরাও এক্ষেত্রে বেশ পেকে গেছে। পড়াশোনার কথা এলে তারা পাল্টা জানতে চায়, ‘এটা কি সিলেবাসে আছে?’ অথবা, ‘এটা কি পরীক্ষায় আসতে পারে?’ শুধু পরীক্ষাকেন্দ্রিক এ পড়াশোনায় প্রতিটা সন্তান হয়ে উঠেছে শুধু পরীক্ষার্থী। শিক্ষার্থী নয়।

হাল বাস্তবতায় মন-মগজে ঢুকে গেছে যে, সিজিপিএ বা জিপিএ হচ্ছে জীবনের সব। জিপিএ-র বাইরে পড়াশোনার পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়েও কিছু কথাবার্তা রয়েছে। যারা না বুঝে, না জেনে অনেক কিছু গিলে মুখস্ত করে ফেলছে তারাও কি প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে? এই শিক্ষাটা কোন কাজে আসছে বা আসবে? এই প্রবণতা পরীক্ষায় নকলের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়।

শুধু মুখস্থ করে উত্তরপত্রে কলম চালানোও নকলই। নকলের উদ্দেশ্যে কাগজে লিখে পরীক্ষার হলে যাওয়া আর মুখস্থ করে মাথায় নিয়ে হলে যাওয়ার মধ্যে ফারাক ততো বেশি নয়। এ বিনাসী সংস্কৃতি রুখতে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মন-মানসিকতার বদলও জরুরি। নইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের এমন দামামা বছর বছর হজম করতেই হবে। আর জমজমাট হতেই থাকবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট হাতড়ানোর সোজা কাজটি।

শিক্ষার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে মেকি ফলাফলে শিক্ষার্থীদের নগদে কিছু আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতকে দুর্বিষহ করারই আরেকটি পর্ব হলো বলা যায়। যদিও এবারের এইচএসসির ফলাফলে জিপিএর লাগামে টান পড়েছিল। গত সাত বছরের মধ্যে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বনিম্ন ফল হয়েছে। গত বছরের চেয়ে কমেছে জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও। বেড়েছে নেতিবাচক শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে।

চলতি বছর পাসের হার কমার জন্য মানবিক বিভাগে পাসের হার কমা, ইংরেজি, পদার্থ ও আইসিটিতে খারাপ ফলকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সিলেট ও যশোর উভয় শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ১০ শতাংশ এবং রাজশাহী ও দিনাজপুর বোর্ডে ৫ শতাংশ পাসের হার কমায় সার্বিক ফলাফল খারাপ হয়েছে। আর বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ কম পাওয়ায় সব বোর্ডে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। মেকি ফলাফলের ছন্দপতন করে হলেও, ভর্তিতে না টিকলেও অন্তত পাস মার্কসও উঠবে না- মেধাবীদের এ লজ্জার হাত থেকে বাঁচানো জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন