ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মামলার দীর্ঘসূত্রিতা

রিয়াজুল হক | প্রকাশিত: ১০:২২ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ভারতের সনি টিভির একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখছিলাম। এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঘোষণা দেয়া হয় সত্য ঘটনা অবলম্বনে অনুষ্ঠানটি নির্মিত।

যাই হোক, এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। ঘটনার শুরুর সময় ১৯৮৪ সাল। দীনা নাথ শর্মা পেশায় একজন পোস্টম্যান। চিঠি, মানি অর্ডার বিলি করাই যার মূল কাজ। ৫৭ রুপি ৬০ পয়সা তছরুপের সন্দেহে অফিসের পোস্টমাস্টার বাবু ১৯৮৪ সালে দীনা নাথের বিরদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। যদিও দীনা নাথ শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন এবং তার যুক্তিও অকাট্য ছিল।

কারণ দীনা নাথ ৩৫৭ রুপি ৬০ পয়সা পোস্টমাস্টারকে জমা দেয়ার ২ মাস পর তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয় যে সে ৩০০ রুপি জমা দিয়েছে এবং বাকি ৫৭ রুপি ৬০ পয়সা জমা দেয়নি। দীনা নাথের ভাষ্য ছিল তাহলে দুই মাস পূর্বে যখন সে অর্থ জমা দিয়েছিল তখন তাকে কিছু বলা হল না কেন?

সরকারি অর্থ তছরুপের অভিযোগ! থানার কর্মকর্তা পর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে দিল সরকারি অর্থ তছরুপ মামলার গুরুত্ব। নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে। তবে তারা দ্রুত কোর্টে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়ে দেবে। কিন্তু দীনা নাথের জন্য দুভাগ্য যেন সামনেই অপেক্ষা করছিল। মামলা দায়ের হবার জন্য দীনা নাথকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হল।

পোস্টমাস্টার বাবু তাকে জানিয়ে দিলেন মামলা নিষ্পত্তি হবার পর তিনি চাকরিতে আবার যোগদান করতে পারবেন। এর আগে নয়। এতোদিন অভাব অনটনেই চলছিল ডাকপিয়নের সংসার। কিন্তু দীনা নাথের চাকরি ছাড়া আয়ের আর কোন পথ ছিল না। কয়েক মাস বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় শহরের ভাড়া বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং গ্রামে চলে আসেন। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময় পর পর দীনা নাথকে কোর্টে এস হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু ৫৭ রুপি ৬০ পয়সা চুরির মামলা আর নিষ্পত্তি হয় না।

সংসার চালানোর জন্য গ্রামের সহায় সম্বল কিছু জমি আস্তে আস্তে বিক্রি শুরু করেন। অর্থের অভাবে দুটি ছোট বাচ্চা অল্প বয়সে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় এবং অন্য এক ছেলে খুব ছোট বয়স থেকেই চায়ের দোকানে কাজ নেয়। আর দীনা নাথ উপার্জনের অবলম্বন চাকরি ফিরে পাবার জন্য কোর্টে হাজিরা দিতে থাকেন।

প্রায় ৩০০ বার হাজিরা দেবার পর তার মামলার নিষ্পত্তি হয় কিন্তু ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে ২৯টি বছর এবং মানসিক ভারসাম্যও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এই ৩০০ বার হাজিরার মধ্যে একটি বারও মামলার বাদী পোস্টমাস্টার আদালতে আসেননি। কিন্তু আনুমানিক ২৫০ নম্বর হাজিরার সময় মামলার এই দীর্ঘব্যাপ্তীতে ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে দীনা নাথ একবার কোর্টে হাজির না হওয়ায় পুলিশ তার বাড়িতে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া ৫৭ রুপি ৬০ পয়সা চুরির মামলা ২০১৩ সালে এসে নিষ্পন্ন হয়।

আমাদের মিডিয়াতেও বিশিষ্টজনেরা মামলার জট সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন মতামত দেন। সবাই মামলার জট নিয়ে যে চিন্তিত এটা আমাদের দেশেপ্রেমেরই অন্যদিক। আমাদের সীমাবদ্ধতা বিচারক থেকে শুরু করে বিচারকক্ষের সংখ্যা সব কিছুতেই আছে। কিন্তু কষ্ট লাগে সামান্য অপরাধের সন্দেহে কিংবা বিনা বিচারেই বছরের পর বছর নিরীহ মানুষদের যখন জেল খাটতে হয়। আর আইনের মারপ্যাচ বুঝতে পারা আমাদের অশিক্ষিত, অভাবী গরিব মানুষের কর্ম নয়।

গত ০৫.০৯.২০১৮ তারিখ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য মতে, সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়ে ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৩টিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৪টি, ফৌজদারি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৫টি এবং অন্যান্য মামলা ৮৮ হাজার ৮৩৪টি। এর মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে ২৯ লাখ ৩৮ হাজার ৪৪৫টি। আর হাইকোর্ট বিভাগে চার লাখ ৯৫ হাজার ৪১৫টি এবং আপিল বিভাগে ১৯ হাজার ৪৯৩টি। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। আদালতগুলোয় মামলার স্তূপ জমে গেলেও সে হারে বাড়েনি বিচারক।

দেশের অধস্তন আদালতে এখন বিচারক সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৭০০। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০। এরপর ছয় মাসে বেড়েছে ৯৮ হাজার ৮৫৩টি। মামলার ভারে জর্জরিত আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। চলতি সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার।

হয়ত দীনা নাথ শর্মার মত অনেক অসহায় মানুষের মামলা বছরের পর বছর আটকে আছে আদালতে। যদি ৩৪ লাখ মামলার মধ্যে ৩৪ কিংবা ৩৪০ টি মামলাও দীনা নাথের মত হয়, তবে তার দায়ভার কে নেবে? কারও জীবন নষ্ট হোক এটা আমাদের কারও কাম্য না। আমি আইনের মানুষ নই। তবে দীনা নাথের মত সামান্য কিছু চুরির সন্দেহে কিংবা খুব সামান্য বিষয়ে করা মামলা বছরের পর বছর ধরে কেন চলবে এটা বুঝতে আমার সত্যিই কষ্ট হয়।

এটা ঠিক আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক দিনের সমস্যা রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে, সেটা হয়তো ভাবা ঠিক হবে না। তবে আইনমন্ত্রী জাস্টিস অডিট সিস্টেম চালু করার কথা বলেছেন, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই মামলার ধরন ও মামলার অবস্থা সম্বন্ধে জানা যাবে এবং মামলার অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ডিজিটাল সময়ে প্রযুক্তি বিমুখ হয়ে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।

আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৬৪টি জেলার লিগ্যাল এইডের অফিসের মাধ্যমে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। বিরোধ নিষ্পত্তি, নারী সহায়তা, মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ, ডিএনএ টেস্টের ব্যয় পরিশোধসহ মামলার ব্যয় পরিশোধ করে থাকে লিগ্যাল এইড অফিস। এছাড়া গরীব অসহায় মানুষ ১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে পাবেন বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা।

গত ২৮ এপ্রিল ২০১৬ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ২৬ হাজার জন ১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে আইনগত তথ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। আমরা সকলেই আশা করছি, দেশের বহু অসহায় মানুষ এই হেল্পলাইনের মাধ্যমে অনেক প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা মুতূর্তের মধ্যেই পাবেন।

আমাদের গরিব, অসহায়, অশিক্ষিত মানুষগুলো অনেক সময় জানেইনা কোথায় বিনা মূল্যে মামলা সংক্রান্ত সেবা পাবে। অনেকেই আছে মামলা চালাতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বসেন। তখন আর সামনের দিকেও এগিয়ে যেতে পারেন না। তাই সব শ্রেণির মানুষকে এই সেবা বিষয়ে জানাতে হবে। মামলা সংক্রান্ত সকল সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান হয়ে যাক, এই প্রত্যাশা সকলের।

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন