ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

যে ক্ষতি অপূরণীয়

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ব্রাজিলের জাতীয় জাদুঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখটি গহন কাল কালিতে আঁকা থাকবে চিরকাল। কেননা, এই দিনে ব্রাজিলের রাজধানী রিও দ্য জেনেরিওতে অবস্থিত জাদুঘরটির সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মানুষের ইতিহাসের এমন কিছু স্মারক, যার ক্ষতিপূরণ কোনভাবেই সম্ভব নয়, কারো দ্বারাই সম্ভব নয়। এই দীর্ঘশ্বাস কেবল ব্রাজিলের অধিবাসীদের হতে পারে না। মানুষের ইতিহাসের অংশীদার প্রতিটি মানুষের জন্য এ দুঃখ অতল স্পর্শী, অসীমে বিস্তৃত।

ব্রাজিলের জাতীয় জাদুঘরটি ছিল প্রাকৃতিক ইতিহাসের জাদুঘর। এখানে কেবল বেড়াতে গেলাম, সেলফি তুললাম, হাহাহিহি করলাম, ব্যাপারটা তা ছিল না। বিজ্ঞানের গবেষণায় এই জাদুঘরের বিভিন্ন সংগ্রহের অবদান ছিল, গবেষকদের কাছে এগুলো ছিল মহামূল্যবান রত্নের চেয়েও বেশি কিছু।

আর তাই এই জাদুঘরটিতে আগুন লেগে সব যখন ছাই হয়ে গেল, তা কেবল প্রকৃতি আর মানুষের ইতিহাসের ক্যাটালগ পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটল না, এখানে সংরক্ষিত সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেল প্রকৃতি আর মানুষের।

জাদুঘরটিতে ছিল মূল্যবান ডাটাসেট, যা নতুন নতুন গবেষণাকে উস্কে দিত, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উদ্ভব ঘটাতো আর জবাব দিত পুরনো কৌতূহলের। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স নিউজ কমপক্ষে মাসে একবার এই জাদুঘরের সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে এরকম খবর দিত- জাদুঘরে নতুন কি প্রজাতির সন্ধান মিলেছে, প্রাচীন পৃথিবীর অমুক প্রাণী কি খেত তা জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা, জীবাশ্মের আসল পরিচয় কোনটি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

brazil

এই জাদুঘরের সংগ্রহের উপর গবেষণায় করেই জানা গেছে ১৯১৮ সালে মড়ক লাগা জ্বরের ভাইরাস আসলে পাখি থেকে মানুষের শরীরে এসেছিল, আর্জেন্টিনার পিঁপড়েরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল কোন্ পথে, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রজাপতিরা বদলে নিচ্ছে চলাচলের পথ। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই সাপের পেট থেকে পাওয়া বীবরের মুখে লেগে থাকা শস্যের বীজ বেঁচে ছিল বলে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, সরীসৃপদের পাকস্থলিতে বীজ হজম করার উপাদান নেই।

এখনো বিজ্ঞান মহলে এই আলোচনা জোরদার, সত্যিই কি সরীসৃপদের পাকস্থলি বীজ হজমে নাজুক? আরও গবেষণার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা, যদিও পুড়ে গেছে সেই বীবর, তার মুখে থাকা শস্য বীজ আর এদেরকে পেটে লুকিয়ে ফেলা সেই বীবাশ্ম সাপটা।

জাদুঘরটির প্রধান কর্মকর্তা জীবাশ্মবিদ আলেকজান্ডার কেলনার সেই ১৯৯০ সালে এক মাংসাশী ডায়নোসর (সান্তানারাপটর প্লাসিডাস) আবিষ্কার করেছিলেন, যা ১১০ মিলিয়ন বছর আগে দুই পায়ে দাবড়ে বেড়াত মাটির পৃথিবীতে। এর নরম তন্তুগুলো পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যা জীবাশ্ম সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিরল সাফল্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল।

brazil

ডায়নোসর, উড়ন্ত সরীসৃপ, প্রাচীন গিরগিটি, কুমির, ম্যামথ, দাঁতাল বেড়াল এবং এরকম হাজারো সংগ্রহ এখন কেবলি অতীত। ২০১৪ সালেই তো কানাডার আলবার্টা য়্যুনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ তিয়াগো সিমোস এবং তাঁর দল প্রাক ক্রেটাসিয়াস যুগের অজানা এক সরীসৃপ (কালানগুবান আলামোই) খুঁজে পেলেন, যা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে ১১ হাজার বছর বয়সী এক মানুষের মাথার খুলি, যার সাহায্যে আমেরিকায় মানুষের বসবাসের ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করা হচ্ছিল।

থমকে গেল সংগ্রহে থাকা প্রাণীদের রেফারেন্স কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজাতির সন্ধান। ২০১৪ সালে জাদুঘরের অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগের সাথে গবেষণা করা জুলিয়ানা এলভিম সামুদ্রিক এক মাছ আবিষ্কার করলেন, যার ভিত্তি ছিল ১৯৫৫ সালে ব্রাজিলের সমুদ্রের তীরে পাওয়া অমেরুদণ্ডী প্রাণীর নমুনা, যে নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাদুঘরে নমুনাটা না থাকলে মাছটাকে নতুন জাত বলেই মানতে হ’ত, বিলুপ্ত প্রাণীর ঠিকুজি পাওয়া যেত না। ২০১৬ সালে এভাবেই তো গুবরে পোকার নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১৭ সালে নিশ্চিত হওয়া গেল উষ্ণমন্ডলীয় পিঁপড়ের নতুন দুই জাত সম্বন্ধে, রেফারেন্স ছিল ১৮০০ সালের সময়কার পিঁপড়ের জীবাশ্ম। অতীতের এক জাতের প্রাণঘাতী ফাঙ্গাস কোথায় কোথায় ছিল, তা খুঁজে বের করতে জাদুঘরের সংগৃহীত নমুনা থেকে ফাঙ্গাস সংগ্রহের কাজ চলছিল, যা আর কখনোই শেষ হবে না।

ডিজিটাল রেকর্ড খুঁজে হারিয়ে ফেলা অমূল্য সংগ্রহের তালিকা তৈরির কাজ চলছে এখন। এছাড়া আর উপায় নেই। গবেষণার কাজ তো থামিয়ে দেওয়া যাবে না। বেশ কিছু জাদুঘর এর মধ্যেই এগিয়ে এসেছে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার রোকা’জ ল্যাব তাদের মাছের সংগ্রহ দিতে চাইছে। ব্রাজিলের জাতীয় জাদুঘরটির পুড়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে আবারো ফিরিয়ে আনার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দেখা যাক, এই যুদ্ধ ক্ষতির কতটা পুষিয়ে দিতে পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন