ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আত্মহত্যা প্রবণতার কোনো সীমান্ত নেই, সবার জন্যই ক্ষতি

নাঈমা জান্নাত | প্রকাশিত: ০৮:৫৪ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী এখনো চ্যালেঞ্জেই রয়ে গেছে। প্রতি বছর সব বয়সী মানুষ যেসব কারণে মারা যায়, তার ২০টির মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যাজনিত কারণ। যেখানে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যায় একটি করে প্রাণ ঝরছে। এভাবে প্রতিদিন আমরা এই সমস্যার কারণে অসংখ্য প্রিয়জন হারাচ্ছি।

তাদের মৃত্যুর প্রভাব পড়ছে আরও বিপুলসংখ্যক মানুষের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরও অনেকে। তাদের ব্যাপারে এখনই দৃষ্টি দেয়ার সময়, যারা আত্মহত্যার ধারণাকে মোকাবেলা করছেন এবং যারা এরই মধ্যে প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। বাংলাদেশে আত্মহত্যায় মারা যায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক নানা কারণে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মাঝে ক্রমাগত বাড়ছে এই প্রবণতা।

প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য `Working Together to Prevent Suicide’ তীব্র কষ্ট, হতাশা ও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতা এবং জেনেটিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণসহ অন্যান্য নেতিবাচক উপাদানের সম্মিলিত ফল আত্মহত্যা।

যেসব ব্যক্তি তাদের জীবনে এ ধরনের জটিল সমন্বিত সমস্যার মুখোমুখি হন, তাদের আচরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার কারণ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও সম্ভব নয়। যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তার অন্যতম ইভটিজিং। চরম হতাশা ও অসহায়ত্ব বোধ থেকে কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় এ পথে পা বাড়ায়।

মাদকাসক্তির মতো সমাজবিরোধী আচরণও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশে যেসব সামাজিক ও পারিবারিক কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলো হলো- চাওয়া-পাওয়ার বৈপরিত্য, যৌতুক প্রথা, নির্যাতনের শিকার, বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্কের ঘাটতি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থ, চাকরি হারানো, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব, দরিদ্রতা, প্রতারণার শিকার হওয়া, ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়া, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অবহেলা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব, সাইবার ক্রাইমের শিকার ইত্যাদি।

এছাড়া আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বিষণ্নতা এবং গুরুতর কিছু মানসিক অসুস্থতা। আত্মহত্যা সম্পর্কে আমাদের সমাজে বেশকিছু স্টিগমা রয়েছে। স্টিগমা হলো এমন কিছু ভুল ধারণা, যা সেই সমস্যা প্রতিরোধের অন্তরায়। এসব ভুল ধারণা আমরা বা আমাদের চারপাশে কেউ না কেউ বারবারই উচ্চারণ করি।

যেমন- ‘সমস্যার সহজ সমাধান পেতেই সে আত্মহত্যা করেছে’, ‘আত্মহত্যা কোনো মানসিক সমস্যা না, এটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা’, ‘ও চাইলেই আত্মহত্যার চিন্তা থামাতে পারে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই’, ‘আত্মহত্যা বিষয়ে খোলাখুলি বলতে নেই, যে এ বিষয়টা জানতো না সেও করে ফেলবে’, ‘শুধু জেদি বা পাগলাটে ব্যক্তিরাই আত্মহত্যার সাহস দেখায়’, ‘আমি এটা কখনই করবো না’, ‘আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিরা স্বার্থপর’, এই ধরনের অগণিত ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত। প্রকৃতপক্ষে ঝুঁকিতে থাকা যে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। তাই আশপাশে কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এক্ষেত্রে আর্লি ওয়ার্নিং সাইন বা আগাম সতর্ক সংকেত হলো- মরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা, নিজেকে আঘাত করা, হঠাৎ করে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, ঘুম না হওয়া, খাওয়া-দাওয়ায় আগ্রহের অভাব, তীব্র হতাশা, পাপবোধ ইত্যাদি। এছাড়া হঠাৎ ব্যক্তির মৃত্যু-সংক্রান্ত সংগীত, চিত্রাঙ্কন বা লেখায় তার আগ্রহ বেড়ে যেতে পারে। নিজের প্রিয় জিনিসপত্র অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া, সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া- এসবই আত্মহত্যার লক্ষণ।

যারা আত্মহত্যার চিন্তা করে, তাদের কথা-বার্তায় সরাসরি মৃত্যুর কথা প্রকাশ পায়। এছাড়া কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যেমন- দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া, হঠাৎ করেই নিজের যত্ন না নেয়া, অপরিচ্ছন্ন থাকা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ, কাটা, ঘা বা ইনজেকশনের সূচের দাগ। কোন ব্যক্তি একাধিকবারও আত্মহত্যার চেষ্টা চালাতে পারে।

যদি আমাদের আশপাশে এ ধরনের কাউকে দেখতে পাই, তবে এক মুহূর্ত দেরি না করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমে তার কাছে সরাসরি জানতে হবে, সে আত্মহত্যার কথা ভাবছে কি-না; কোন পরিকল্পনা আছে কি-না বা করছে কি-না। তবে সব কিছু সতর্কতার সঙ্গে এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার ঝুঁকির মাত্রা নিরূপণ করতে হবে।

দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে ওই আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব। কেউ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলে আমরা যে ক’টি পদক্ষেপ নেব, তা হলো- অন্য কাউকে জানানো, সে ব্যক্তি পরিবারের কেউ হলে ভালো হয়, দ্রুত বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়া, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি যতক্ষণ না সাহায্যের আওতায় আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে একা না ছাড়া, যা যা দিয়ে তিনি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বা করতে পারেন, তা দূরে সরিয়ে রাখা। যেমন- দড়ি, বিষ, ছুরি, বন্দুক, হারপিক, স্যাভলন, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ইত্যাদি।

তবে নিজে এ ধরনের সমস্যা অনুভব করলে দেরি না করে নিজ দায়িত্বেই বিশেষজ্ঞ তথা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াস্ট্রিস্ট, সাইকোথেরাপিস্টের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব, যখন আপনি নিজেই হবেন একজন মূল কর্মী। আমরা প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে পরিবর্তন আনতে পারি। একজন সমাজের কর্মী হিসেবে, একজন সন্তান হিসেবে, পিতা-মাতা হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে বা প্রতিবেশী। আমরা প্রতিদিনই কোন না কোন কাজ করতে পারি আত্মহত্যার আচরণ প্রতিরোধ করতে। আমরা যা যা করতে পারি, তা হলো- আত্মহত্যা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা, আত্মহত্যার আর্লি ওয়ার্নিং সাইন সম্পর্কে নিজে জানা ও অন্যকে জানতে সাহায্য করা, যারা বা যাদের পরিবার এ ধরনের দুর্দশায় আছেন, তাদের প্রতি সহযোগী হওয়া।

আত্মহত্যার বিদ্যমান ভুল ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলুন এবং আপনার জানা বিষয়গুলো উপস্থাপন করুন। ফলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের সমাজে স্থায়ী, টেকসই ও বড় ধরনের সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রমাণভিত্তিক কর্মসূচি নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে বিশ্বের আনাচে-কানাচে যারা আত্মহত্যা প্রতিরোধে সংগ্রাম করছেন, তাদের পর্যন্ত পৌঁছায়। আমাদের সবাইকে একটি সাধারণ লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং তাতে সম্মিলিতভাবে অংশ নিতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব এই দলে থাকবে।

যেমন- ধর্মীয় নেতা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সমাজকর্মী, শ্রমজীবী, মাদকাসক্ত কেন্দ্র, জরুরি সেবা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সদস্য, সরকার, গণমাধ্যম, মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি, আত্মহত্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।

প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা, কষ্ট ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম গবেষণা, মূল্যায়ন এবং ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে আমরা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমরা যে কেউ ব্যক্তিগত ভূমিকা রাখতে পারি। এক্ষেত্রে সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার সমন্বিত সম্মিলন প্রয়োজন।

লেখক- নাঈমা জান্নাত, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। Emil: [email protected]

এমআরএম/এমএস

আরও পড়ুন