প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স : একটি সাধারণ বিশ্লেষণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য প্রেস কনফারেন্স একটি সত্যিই আনন্দদায়ক বিষয়। এর কারণ হিসেবে তার প্রশংসাকারীরা বলবেন যে, তিনি আসলে সাংবাদিকদের তার সরকারের সাফল্য সম্পর্কে জানাতে চান এবং তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। তার নিন্দুকেরা বলবেন যে, তিনি প্রেস কনফারেন্সের নামে সাংবাদিকদের কাছ থেকে স্তুতি শুনতে ভালোবাসেন বলেই কথায় কথায় প্রেস কনফারেন্স করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর পরে এরকম প্রেস-বান্ধব প্রধানমন্ত্রী আর কখনোই আসেননি।
এখানে প্রেস-বান্ধব বলতে গণমাধ্যমের হিতৈষী হিসেবে যদি কেউ শেখ হাসিনাকে ভাবেন তাহলে ভাবতে পারেন কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি যে, তিনি তার পিতার মতোই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে, সময় কাটাতে পছন্দ করেন এবং সরাসরি নিজের বক্তব্য (তা আপনাকে মানতেই হবে তেমন কথা নেই) গণমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করতে পছন্দ করেন।
তাকে কারা কি প্রশ্ন করবেন তা যেমন আগে থেকে জানানো হয় না তেমনই তিনিও অনেক সময় প্রস্তুতিহীন হয়েও প্রশ্নটির উত্তর দেন। কখনও বিরক্ত হন বা রেগে যান, কখনও খুশি হন, কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে একটি দেশের সরকার-প্রধানের এই যে সরাসরি যোগাযোগ একে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি বিশাল পাওয়া বলে ভাবতে যারা অসুবিধে বোধ করেন তারাই কিন্তু রাত দিন চেঁচাচ্ছেন যে, দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক্ স্বাধীনতা নেই।
অথচ বাংলাদেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি দেখুন। বিএনপি’র কথাই যদি ধরি তাহলে আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রেস কনফারেন্স বা সাংবাদিক বৈঠকের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি না যেখানে বিএনপি’নেতা সরাসরি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বা আয়োজন করে নিজেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
প্রায়শঃই সাংবাদিকদের ডেকে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠের মধ্য দিয়েই এই দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হয়। এমনকি বিএনপি মহাসচিব বা দলের অফিস-রক্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করা রুহুল কবির রিজভী সাহেবের প্রেস কনফারেন্সও একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ বৈ কিছু নয়। বাকি রাজনৈতিক দলগুলির কথা না হয় বাদই দেওয়া গেলো, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ব্যতিক্রম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন তেমনই তার দলের সাধারণ সম্পাদকও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালোবাসেন বলেই মনে হয়। কখনও কখনও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দলের মনোভাব জনগণ জানতে পারে কখনও কখনও তাদের বক্তব্যের কারণে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয় বা কেউ কেউ হাস্যকর হয়ে পড়েন কিন্তু এটাও যে গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের অংশ সেটা আমাদের স্বীকার করতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রী একেকবার একেকটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন আর তারপর কয়েকদিন ধরেই তার সকল বক্তব্য চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে থাকে। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা তার কথা বলার ভঙ্গি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখাও খোঁজা হয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যা বলার। তিনি কোনো প্রকার রাখঢাক না করেই বলেই বলেছেন যে, বিএনপি’র সঙ্গে তিনি আর কোনো আলোচনায় বসতে আগ্রহী নন। তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন তিনি আলোচনায় বসতে চান না।
সে ব্যাখ্যা আমাদের মনঃপূত নাও হতে পারে কিন্তু তিনি সেটা জনগণের সামনে স্পষ্ট করেছেন সেটাও কম কথা নয়। আমরা হয়তো ভাবতে থাকতাম যে, এই বুঝি বিএনপি’কে আবারও তিনি সংলাপে আহ্বান করবেন। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো কালে সংলাপ বলে কোনো প্রক্রিয়া সফল হয়েছে বলে নজির নেই। তারপরও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এরকম একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার এবং তার ব্যবহারও হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দিলেও অনেকে বলতে চান যে, সংলাপ হওয়াটা জরুরিই।
নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি স্পষ্ট। তিনি এর আগেও বলেছেন এবং আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনেও বললেন যে, কোনো শক্তির পক্ষেই নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। নির্বাচন হবেই এবং নির্বাচনে কে অংশগ্রহণ করবে আর কে করবে না, সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন না বা কাউকে তিনি দাওয়াতও দেবেন না। তিনি সংবিধান অনুযায়ী একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন এবং নির্বাচনে জনগণ তাকে ভোট দিলে তিনি থাকবেন, না দিলে তিনি থাকবেন না, তার ‘কিচ্ছু আসে যায় না’।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে টক-শো’য় বিস্তর আলোচনা হয়েছে, অনেকের বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, আমি নিজেও দু’টি টক শো’য় এই সংবাদ সম্মেলন নিয়ে কথা বলেছি এবং অন্য বক্তাদের কথা শুনেছি। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, আত্মম্ভরী এবং একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী বলে মনে করছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে, বাঙালি এতো অহঙ্কার পছন্দ করে না। কিন্তু শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন বা জানেন, তারা সকলেই একথা বলছেন যে, তিনিতো এরকমই, এটা তার স্বভাবসুলভ আচরণ, তিনি তার স্বভাবের বাইরে গিয়ে ভণিতা করতে পারেন না এবং তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই-ই বলেন বা করেন।
আবারও এখানে বলা যায় যে, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই প্রেস কনফারেন্স থেকে কী বক্তব্য আশা করেছিলাম? আমরা কি চেয়েছিলাম যে, তিনি বলবেন, তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সকল দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে আগামী নির্বাচনে দলকে অংশগ্রহণ করাবেন? নিশ্চয়ই এরকম বক্তব্য কেউ আশা করেননি। তাহলে তার এই সত্য ও স্পষ্ট উচ্চারণকে আমরা কেন নিতে পারছিনে? বরং তিনি যেভাবে বা যা বিশ্বাস করেন নির্বাচন সম্পর্কে সেটাই উচ্চারণ করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে তিনি আবারও সেই কথাই বলেছেন যে কথা এতোদিন ধরে বলেছেন। তিনি বা তার সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে রাখেনি, দুর্নীতির দায়ে আদালতের মাধ্যমে সাজা লাভ করে বেগম খালেদা জিয়া কারাদণ্ড ভোগ করছেন। আইনের মাধ্যমেই তিনি মুক্তি লাভ করতে পারেন কেবল। কিন্তু এ প্রশ্নও সঙ্গত যে, যে মামলায় তিনি কারাদণ্ড ভোগ করছেন সে মামলায় তার জামিন হয়ে গেলেও বাকি মামলায় তিনি জামিন পাননি।
কাজেই এতে সরকারের কোনো প্রকার হাত নেই সে কথা আমরা মনে করতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান দুই দলের মধ্যে বা প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যে কখনও সৌহার্দ বজায় থেকেছে বলে আমরা যারা এই দুই নেতার রাজনীতি দেখে দেখে বড় হয়েছি তাদের স্মৃতিতে তেমন কোনো ঘটনা নেই।
ফলে শেখ হাসিনা এই বিষয়টি এড়িয়েই যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এবং পৃথিবীর তাবত রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাগণ সাংবাদিকদের সামনে এসে অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হলে সেটি এড়িয়ে যান না বা তার নিজের মতো করে একটি উত্তর দেন না এমনটি পাওয়া যাবে না। ফলে শেখ হাসিনা এক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছুই করেননি।
দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে যেমন হঠাৎই কিছু নতুন নতুন পক্ষ ও চেহারা উন্মোচিত হয় তারই ধারাবাহিকতায় আবারও এদেশে আমাদের পরিচিত ও পুরোনো কিছু চেহারা একটি রাজনৈতিক ঐক্য গঠন করেছেন যারা মনে করছেন যে, আগামী নির্বাচনে তারা একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে এই নতুন অথচ পুরোনো জোটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি একে মনে করছেন যে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার দলের বিরোধী পক্ষের একটি সংযোজন, যা আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
একথাতো সত্য যে, বাংলাদেশে রাজনীতি আসলে আবর্তিতই হয় আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী একটি বিশাল প্ল্যাটফরমের ভেতর দিয়ে। আমরা সকলেই এই রাজনীতিকে চিনি ও জানি। শেখ হাসিনা তাদের সম্পর্কে হাস্য-পরিহাস করেছেন এবং প্রত্যেক পুরোনো ও চিহ্নিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটি বা দু’টি লাইন বলেছেন। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের ব্যাপারে হাস্যরসের মাধ্যমে বক্তব্য প্রদান নুতন কিছু নয় এবং এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শুধু সিদ্ধ নয় বরং গুণ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের না হয়ে ভারত কিংবা ব্রিটেনে রাজনীতি করলে শুধুমাত্র তার এই ‘উইট’ বা ঠাট্টার কারণেই বিখ্যাত হতেন। কিন্তু এদেশে যেমন আমরা ব্যক্তি জীবনেও হাস্যরস নিতে পারি না, তেমনই আমরা রাজনীতিতেও সিরিয়াস থাকতে চাই সব সময়ই, কিন্তু তাতে কাজের কাজ খুব কিছু হয় না।
শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদগণ তাকে প্রায়শঃই কটূক্তি করেন যা গালাগালের পর্যায়ে পড়ে, এমনকি সংসদেও সেটা হয়। যদিও সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও কম যান না প্রতিপক্ষকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করতে। কিন্তু তার চেয়ে এরকম নির্দোষ ঠাট্টা কিন্তু পরিস্থিতিকে কখনও কখনও হাল্কা করে।
প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে যে, নির্বাচনের অব্যবহিত আগে প্রধানমন্ত্রী ও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলন থেকে জাতি কী বার্তা পেলো? এটা কি কেবলই একটি গতানুগতিক সাংবাদিক সম্মেলন নাকি এর থেকে সামনের রাজনীতিরও একটি ইশারা আমরা পেলাম। আমি নিশ্চিত সকলেই এই প্রেস কনফারেন্স এবং এর পরবর্তী আলোচনা-সমালোচনা সম্পর্কে অবগত। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে যে, এই সাংবাদিক সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। প্রতিটি পক্ষেরই এরকম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়াটা আবশ্যক বিশেষ করে এরকম সংকটকালে।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে তখন প্রধানমন্ত্রী এই সাংবাদিক সম্মেলনেই বলেছেন যে, এ নিয়ে তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। ফলে উত্তেজনা একটু প্রশমিত হয়েছে বটে। এরকম আরো কিছু বক্তব্য নির্বাচনী রাজনৈতিক উত্তেজনায় একটু হলেও পানি ছিটিয়েছে। আমার মনে হয়, এই প্রেস কনফারেন্স বা সংবাদ-বৈঠক আমাদের একটু হলেও জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ঈদের পরের রাজনীতি নিয়ে আমরা যারা বেশ আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম, সে আতঙ্ক একটু হলেও দূর হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম