অবাধ্য সন্তান ও বাবা-মায়ের দায়
বিষয়টি এখন অনেক অভিভাবককে ভাবিয়ে তুলেছে। বর্তমান সময়ে অনেক সন্তান অবাধ্য ও খামখেয়ালী। বাবা স্কুলের দারোয়ানের চাকরি করে। ছেলের প্রতিদিন হাত খরচ লাগবে ১০০ টাকা কিংবা শাওমির নতুন মডেলের স্মার্ট ফোন। না দিলে ঘরে ভাংচুর করে। বাবার কাছে বাজার করার চেয়ে ছেলের হাত খরচ দেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সন্তানের কাছ থেকে পরিবার কি আশা করবে? তবে আমরা অনেকেই বুঝি না যে, সন্তান অবাধ্য হবোর পেছনে বাবা-মা অনেক সময় সরব, আবার অনেক সময় নিরব ভূমিকা পালন করে থাকে।
আপনার সন্তান মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে। স্কুল, কলেজে যাবার সময় তার বাইক খুবই দরকার। নাহলে রাস্তায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। পড়ার সময় কমে যায়। এরকম বুঝানোতে যদি বাবা বুঝতে পারে, তবে ভালো ভাবেই সমস্যার সমাধান হল। এই চাহিদা পূরণ করে আপনি আপনার সন্তানকে অহেতুক ভোগ বিলাসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন।
বিভিন্ন বেয়ারা ছেলেদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াবে। সন্তান বেয়ারা হবার প্রাথমিক শিক্ষা আসলে পরিবার থেকেই পেয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে বাইক কিনে না দিলে ছেলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়, সাথে মা খাওয়া করে দেয়। বাবার সাথে ছেলে, মা কেউ কথা বলে না। এটা এখন অনেক জায়গায় পারিবারিক ঐতিহ্য হয়ে গেছে। তবে আপনার সন্তান কি শিখবে?
সন্তানদের কথা বিবেচনা করেই প্রতিটি বাবা-মাকে কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত-
১. বাবা যখন সন্তানকে শাসন করবে, মায়েদের সেই সময় নিরব থাকা উচিত। বাবা বকা দেয়ার সময় মা যদি বলে ওঠে, “এতটুকু বাচ্চাকে বকাবকি করছো কেন?” কিংবা “যথেষ্ট হয়েছে আর না” । মনে রাখবেন, বাবার প্রতি সন্তানের ভয় আপনি ভেঙ্গে দিলেন। মায়েরা চুপ থাকলে, সন্তান ভেবে নিতো বাবার বকা খাওয়া যাবে না। কারণ বাবা রেগে গেলে তাকে শাসন করবে। কেউ ঠেকাতে আসবে না।
২. বাবা মা একসাথে কখনও সন্তানকে শাসন করবেন না। একজন বকাবকি করলে, অন্যজন চুপ থাকবেন। এতে করে সন্তান নিজেকে অসহায় মনে করবে না। আবার প্রশ্রয়ও পাবে না।
৩. সন্তানের সামনে বাবা-মা কখনও ঝগড়া করবেন না। এতে করে সন্তান নিজেকে একা মনে করে। নিজের একাকিত্ব দূর করার জন্য সন্তান বিভিন্ন সঙ্গ দোষে জড়িয়ে পড়ে। আর বর্তমান সময়ে সঙ্গ দোষের প্রভাব এতটাই মারাত্মক, এখান থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। কারণ আগে সঙ্গ দোষে কেউ কেউ সিগারেট খেতো কিংবা পড়া ফাঁকি দিয়ে জোট বেধে সিনেমা হলে যেত। আর এখন সঙ্গ দোষের কারণে সন্তান মাদকসেবী হচ্ছে, বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করছে।
৪. সন্তানের সামনে মায়েরা বাবাদের সাথে তর্ক করবেন না। এর ফলে সন্তান বাবাকে আর ভয় করে না। আর বাবাকে ভয় না করলে, মা’কে ও ভয় করবে না। এই সাধারণ বিষয়টি আমাদের অনেক মায়েরাই বোঝে না।
৫. মায়েরা চাকরি করে। তবে সন্তান যখন কোন কিছু আবদার করবে, তখন অবশ্যই ভালো খারাপের বিবেচনা করতে হবে। যদি খারাপের আধিক্য থাকে, তাকে বোঝাতে হবে যে বাবার অনুমতি লাগবে। একই সাথে এতে করে সে ছোট বয়সেই পারিবারিক চেইন অব কমান্ডের একটা শিক্ষা পেয়ে যাবে।
৬. সন্তানকে লেখাপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝান। ভালোভাবে লেখাপড়া করলে জীবনে কি কি করা সম্ভব, তার একটা রূপরেখা তার মনের মধ্যে গেথে দিন। আপনার সন্তান নিজের মত করেই নিজের চলার পথ তৈরি করে নেবে। আপনাকে বেশি কিছু বলে দিতে হবে না।
৭. আপনার অর্থ বিত্ত আছে। এর মানে এই নয় যে, সন্তান যা চাইবে, কোন কিছু বিবেচনা না করেই তাকে কিনে দিতে হবে। প্রতিদিন বাড়িতে আসার সময় বাচ্চার জন্য একই জিনিস কিনে আনছেন। প্রয়োজন নেই, তবু আনছেন। সন্তানেরও নিত্য নতুন বায়না শুরু হচ্ছে। বাবা-মা কিনে দিচ্ছে। মায়েরা চাকরি করলে কোন কথাই নেই।
আর যদি মায়েরা চাকরি না করেন, তবে মায়েরা বাবাদের ফোন করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাদের সন্তানদের নিত্য নতুন বায়নার কথা। কিন্তু অহেতুক উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ পায় না। এতে করে আপনি আপনার সন্তানদের লোভী করে গড়ে তুলছেন।
৮. সন্তানের বেডরুম বাবা-মায়ের রুমের পাশেই রাখতে হবে। ব্যতিক্রম কিছু কারণ ছাড়া সন্তান যেন রুমের দরজা না লাগিয়ে রাখে, সেদিকে কড়াকড়িভাবে খেয়াল রাখতে হবে। একবার যদি এই বদঅভ্যাস তৈরি করে ফেলে, তবে পরবর্তীতে মেরে পরিবর্তন করতে পারবেন না।
৯. পরিবারে চেইন অব কমান্ড অত্যন্ত জরুরি। যে যার মত চলবে, সেটা পরিবারের ঐতিহ্য হতে পারে না। পরিবারের বড় সন্তান যদি বাবা-মায়ের কথা না শোনে, তবে তার প্রভাব পরবর্তী সন্তানদের উপরও পড়ে। পরিবারে অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকতে হবে।
১০. বাবা-মা তাদের সন্তানদের অবশ্যই স্নেহ করবে। তবে অতিরিক্ত আদর স্নেহ সন্তানকে পরনির্ভরশীল ও আত্মশক্তিহীন করে তোলে, যা মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসা যেন সন্তানের অঙ্গলের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
১১. সন্তান ছোট থাকতেই খেয়াল রাখুন কার সাথে সে চলাফেরা করে। একবার সঙ্গদোষে জড়িয়ে পড়লে, তাকে ফেরাতে পারবেন না। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়া। সন্তানকে যথেষ্ট সময় দেওয়া।
আমাদের মায়েরা চাকরি করে। হাতে টাকা আছে। সন্তান যদি এক বেলা না খেয়ে আইফোন কিনে দেবার জেদ ধরে, মায়েরা কিনে দিচ্ছে। এতে করে কি সন্তানের মঙ্গল হচ্ছে? আসলে অমঙ্গল ডেকে আনা হচ্ছে। এরপর মোবাইলের মডেল পরিবর্তনের বায়না ধরবে। অনেকেই বাচ্চাকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখেন। এত করে আপনার সন্তান সাময়িক সময়ের জন্য ঠাণ্ডা থাকছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল অতিশয় খারাপ। কারণ খুব ছোট বয়সে টেলিভিশনের প্রভাব তার উপরে পড়ে যায়।
আপনার সন্তান মাদকসেবী। আপনার দিন রাতের ঘুম হারাম। অথচ একদিনে আপনার সন্তান এই বিপথে পা বাড়ায় নি। যখন দিনের পর দিন বাইরে থেকেছে, তখন তার কোন খোঁজ নেন নি। যখন আসক্তির শেষ পর্যায়ে, তখন আপনার টনক নড়েছে। আমরা সন্তানদের ছোট থাকতে নৈতিকতার শিক্ষা দেই না। ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝাই না।
এখন অনেকের কাছেই শোনা যায়, সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ঘরে ঢুকলে, আদরের সন্তান বাবার মুখের দিকে তাকায় না, হাতের দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কি এনেছে তা দেখার জন্য। এটা বাবা-মায়েদের ভুল। বেশি ভালোবাসা দেখাতে যেয়ে, সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনছি। সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করুন। এখন অনেক ধনী পরিবারের স্কুলের ছেলেরা বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করছে।
পরিবারের মধ্যে খেয়াল করারও কেউ নেই। ১০-১২ বছরের ছেলেরা বিভিন্ন আজব স্টাইলে চুল কাটছেন, পরিবারের কেউ কিছু বলছে না। স্কুলের শিক্ষার্থী, রাত ১০ টার পরে বাসায় ফিরছে, বলার কেউ নেই। বাবা কিছু বললে, মা রেগে সন্তানের পক্ষ নিচ্ছে কিংবা মা কিছু বললে, বাবা সন্তানের পক্ষে চলে যাচ্ছে। সন্তান প্রশ্রয় পাচ্ছে।
বাবা-মা যদি সন্তানকে প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিতেন, এই ভাবে চুল কাটা যাবে না কিংবা এভাবে রাত করে ঘরে ফেরা যাবে না। তাহলে সন্তান বুঝে যেত, এটা তার ভুল হয়েছে। ছোট ছোট ভুল যদি সংশোধন করে না দেন, তবে পরবর্তীতে বড় ধরনের অন্যায় সংশোধন করার মত ক্ষমতা আপনার হাতে আর থাকবে না।
সন্তান অবাধ্য হবেই। এখন সমাধান আপনার হাতে। কিভাবে সন্তান মানুষ করবেন। তবে প্রতিটি পরিবারের চেইন অব কমান্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা প্রতিটা পরিবারে থাকা উচিত। বাবা-মা দুজনের হাতে টাকা থাকা মানেই যা খুশি তা করা ঠিক নয়। এর ফলাফল আর যাই হোক, ভালো হয় না। নিজেদের জন্য না হোক, সন্তানের জন্য আমাদের অনেক কিছু মেনে চলা উচিত।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম