এমন নেতা কি আর জন্মাবে এদেশে?
আগস্ট বাঙালির জীবনে শুধু শোকের নয়, এটি কালিমালিপ্ত অভিশপ্ত মাসও বটে। সেই সর্বনাশা রাতের দৃশ্যপট মানসচক্ষে একবার ভেসে উঠলেই শিহরিত হতে হয়। সেই যে মানুষটি ভালোবেসেছিলেন বাঙালি জাতিকে। বীর হতে চাননি তিনি; ভয় পাননি শহীদ হতে। রক্ত দিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা। তাকে কী করে ভুলবে বাঙালি?
সেই ১৫ আগস্ট। সিঁড়িতে পড়ে আছে বাঙালি জাতির প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তমাখা নিথর দেহ। সিঁড়ি গড়িয়ে রক্ত চলে এসেছে বাহির আঙ্গিনায়। মহান সেই নেতার রক্ত সোঁদা মাটিতে মিশে গেছে। তিনি তো শুধু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন না দলবিশেষের প্রধান।
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী ঝড়-মেঘ ইতিহাসের পথে আমাদের যাত্রায় তিনি ছিলেন সঙ্গী ও পথপ্রদর্শক। তাকে ভুলব কেমন করে? তাকে কি ভোলা যায় কখনো? তাই তো ইতিহাসের এই মহানায়কের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, “যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা/গৌরী, মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান”।
বঙ্গবন্ধু ক্ষমতাকে ভালোবাসেননি, হৃদয় দিয়ে দেশকে ভালো বেসেছেন, দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন। অর্থ লোভ তাঁকে ছোঁয়নি কখনো। দেশের ভালোবাসার কাছে তাঁর কাছে অর্থ ছিলো তুচ্ছ। এমন নেতা কি আর জন্মাবে কখনো এদেশে? যা দেখছি তাতে বোধ করি না। বঙ্গবন্ধু আর আসবেন না কখনো। বাংলাকে ভালোবাসার এমন মানুষ আর কখনোই আসবে না এদেশে। তাঁর মতো করে কেউ বাংলাকে আর ভালোবাসবে না; আমাদের তাঁর মতো করে কেউ আর কেউ আগলে রাখবে না।
আমরা সত্যি অকৃতজ্ঞ জাতি। যিনি আমাদের দেশমাতৃকাকে উপহার দিলেন, এই তাকেই কত না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। শুধু তই নয়, হত্যাকারীরা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। সেখানে কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ছবি এদেশে নিষিদ্ধ ছিল।
বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশের নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারক ওই সামরিক শাসকরা তাতে ভয় পেত। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানত জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা আরো জানত সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোনো কিছুতেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু সরকার বদলই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া জাতির অনেক অর্জনকে নস্যাত্ করা হয়েছিল, বদলে দেয়া হয়েছিল দেশের সংবিধান ও মূলনীতি। সেই শোক, সেই বেদনা, সেই ক্ষোভ বুকে নিয়েই দেশবাসী কাটিয়েছে এই দীর্ঘ সময়। বঙ্গবন্ধু হত্যার কলঙ্ক কোনোদিন ঘুচবার নয়, তাকে এভাবে হারানোর বেদনার কোনো উপশম নেই। তারপরও সান্ত্বনা এটুকু যে, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে এবং খুনিদের অন্তত পাঁচজনের ফাঁসি হয়েছে।
একটি ঘৃণ্যমহল জাতির জনকের হত্যার বিচার হোক তা চাইছিল না বলেই বিলম্বিত হলো বঙ্গবন্ধুর বিচার। তাদের হেলাফেলায় অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। একে একে কেটে গেল প্রায় ৪ যুগ। সময় অনেক গড়ালেও এ জাতি তাদের জনকের হত্যার বিচার পেয়েছে। এটা বড়ই আত্মতৃপ্তির। হত্যাকারীদের ফাঁসির বিষয় নিয়ে যারা অতৃপ্ত ছিলেন, তারা এখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। এদের সাথে আমি আজ সুখ অনুভব করছি। ১৫ আগস্ট এলে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হতো। ঘৃণা হতো নিজের প্রতি। মনে হতো আমরা কতটাই না অসভ্য।
কয়েক বছর আগের কথা। ১৫ আগস্টে নারায়ণগঞ্জের এক শোকসভায় অশীতিপর এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থতা নিয়েই হাজির হন। তাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুনেছি “জাতির পিতার হত্যার বিচারটা বুঝি আর দেখে যেতে পারলাম না”। তিনি আর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দেখে যেতে পারেননি। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার দু’মাস আগে পরলোকগত হয়েছেন। বুঝি কতটা অতৃপ্তি নিয়েই না দুনিয়া ছাড়লেন তিনি! আমার তৃপ্তিটা এখানেই, আমি তো অন্তত জাতির জনকের বিচারটা দেখে যেতে পারলাম। আমার তৃপ্তি এখানেই, আমার মুক্তিযোদ্ধা পিতা জাতির জনকের খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলতে দেখে হেঁসেছেন।
কি নির্মম, কি নিষ্ঠুর ইতিহাস। যিনি জাতির জন্ম দিলেন; যার জন্ম না হলে এদেশের জন্মই হতো না, সেই জাতির জনককে কি নিষ্ঠুরভাবেই না হত্যা করা হলো। জাতির জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হলো সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ওদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন রেহানা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউই বেঁচে নেই।
পঁচাত্তরের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল। আজ তার হাতে গড়া দলই জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে পঁচাত্তরের সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। জেনারেল জিয়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান বদল করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করেছিলেন। আদালত সেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশাল প্রতীক এবং নিরন্তর প্রেরণার উৎস। এইসব উপাদানের সমন্বয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সর্বোচ্চ স্থানটি যে বঙ্গবন্ধুর যুক্তিবাদী, বিচারশীল এবং ইতিহাসবোধসম্পন্ন সকল মানুষই এটা স্বীকার করবেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তবুও কিছু লোক বিতর্ক তুলেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার জোরে অন্যায়ভাবে বাতিলও করে দিয়েছেন।
তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল অদূরদর্শী, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং ইতিহাসকে অস্বীকার করার নামান্তর। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী নানা অস্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে এই দিনটিকে ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক নানা স্বার্থ, স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত এবং কিছু লোকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে এটি সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন এই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করল তখন তাকে সকল গণতান্ত্রিক, ইতিহাসবোধসম্পন্ন ও শুভবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত দলের মানুষেরই এটা মেনে নেয়া উচিত ছিল।
কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং তারই ফলে মানুষের মনে তার চিন্তা-চেতনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধাপে ধাপে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায়। ছাত্র অবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন, কপ, পিডিপির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মহানায়ক হিসেবে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
অদম্য সাহস ও অকুতোভয় আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি নিজের বাঙালি সত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা সচক্ষে দেখেছি।
১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। মিত্রশক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সঙ্কল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না। তারপর সেই ৭ মার্চের ভাষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যে শুনেছে সে ভাষণে তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুত্প্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে?
কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়, ভাষার কোনো কারুকার্য নয়, বলবার কোনো পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এ দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রুদেশে বন্দি থাকা স্বত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকলে, তেমনি প্রবল আকাঙ্খা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার।
বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না’। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। এর পর গড়িয়ে গেছে বহু বছর। সবচেয়ে বড় কথা এতকিছু ঘটার পরও রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আগের জায়গাতেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক কালচার বদলায়নি মোটেই। রাজনীতিতে হানাহানি,দেশের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড, রাজনীতির উদ্দেশ্য হাসিল, রাজনীতির জন্য রাজনীতি এইতো চলছে দেশে।
বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পরে স্বপ্ন দেখা মানুষ গুলো। তিনি চলে গেলেন। আর ফির এলেন না। আফসোস, এমন একটা নেতা এদেশের আর জন্মায়নি একটিও। তাঁর মতো করে বাংলাকে আর ভালোবাসবেনি কেউ, দেশের মানুষকে আগলে রাখেনি কেউ। হে মহান নেতা ভালো থাকো, স্বর্গীয়সুখে থাক। হাজারো সালাম তোমায়।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস