ছাত্রলীগ থেকে শিখুক স্বেচ্ছাসেবক লীগও
কবির য়াহমদ
মুসলমানদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহায় এবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনের এ ইউনিটটি ঈদের দিনে শহরের কয়েক কিলোমিটার বর্জ্য অপসারণের প্রশংসনীয় কাজ করেছে। সম্পূর্ণ স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের সে কাজটি প্রশংসাযোগ্যতার পাশাপাশি অনুকরণীয়ও বটে।
শহরের বর্জ্য অপসারণের কাজটি সেখানকার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর। গ্রামাঞ্চলে যে কাজগুলো নাগরিকরা নিজেরা করে থাকেন শহরে সে কাজের জন্যে পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল, কাজের ধীরগতির কারণে অনেক সময় অনেক জায়গায় এসব বর্জ্য অপসারণের কাজ দীর্ঘসূত্রিতায় পর্যবসিত হয়। ইত্যবসরে সে সব বর্জ্যে নাগরিকপ্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তদের অনেকেই পশু বর্জ্য অপসারণে নিজেরা উদ্যোগী হন না। যেখানে-সেখানে পশু জবাই ও বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশে মারাত্মক প্রভাব, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আর পরিবেশ দূষিত হওয়ার বিষয়টি তারা অনুধাবন করলেও নিজেরা সে প্রতিকারবিধানে আগ্রহী হন না। ফলে দেখা যায় পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোরবানিস্থল নির্ধারণ করে দিলেও সে জায়গাগুলো ব্যবহার হয় না। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে প্রচারণা চালালেও এটা কেউ না মানলে প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কাউকে সেটা মানতে বাধ্য করতে পারে না।
পৌরসভাগুলোর আলোচনা বাদ দিলেও প্রতিবারের মত আমরা দেখেছি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্ধারিত পশু জবাই স্থান এবারও নাগরিকরা গ্রহণ করেন নি। যত্রতত্র পশু কোরবানি ও বর্জ্য ফেলার ঘটনা ঘটেছে এবারও। এবারও ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানদের এই নির্দেশনা না মানার পরেও কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় নি, আগামিতেও হয়ত হবে না। কারণ এখানে আছে ধর্মের যোগ।
নগর ও পরিবেশ সুরক্ষার জরুরি বার্তা এই ধর্মযোগে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে কাউকে জোর করা হলে সে যদি ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধান পালনে বাধা প্রদানের অভিযোগ আনে তবে লোকজন বিনাবাক্য ব্যয়ে, বিনা যুক্তিতে সেটাই মেনে নিত। অথচ ধর্মীয় বিধান পালনে পরিবেশ দূষণের সব পন্থাগুলো এড়িয়ে চলাই ছিল সকলের, এবং নিশ্চয়ই ধর্ম পরিবেশ সুরক্ষাজনিত যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধী থাকার কথাও নয়।
দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকবলের ঘাটতি রয়েছে। অনেক নগর ও শহরে নির্ধারিত সময়ে বর্জ্যও অপসারণ হয় না। আর কোরবানির সময়ে মাত্র একদিনে যে পরিমাণ বর্জ্যের স্তূপ জমে সেটা এক সপ্তাহের স্তূপের প্রায় কাছাকাছি কিংবা এরচেয়েও বেশি। ফলে আগের লোকবল নিয়ে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অপসারণ যে কষ্টকঠিন এক কাজ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সুখের খবর হচ্ছে দেশের অনেকগুলো নগর ও শহরের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছে, এবং বাকিদের জয়ের সে সংকল্প ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক দায়িত্ব পালনের দরকার ছিল সকলের। নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই ও বর্জ্য ফেলার দরকার ছিল, কিন্তু নাগরিক সে দায়িত্ব পালন করে নি পুরোপুরি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় অনেক এলাকার রাস্তাঘাটই ময়লার ভাগাড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। সেসব এলাকার অধিবাসীগণ রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে ময়লা ফেলে, পশু জবাই করে নিজেরাই অপেক্ষায় থেকেছেন পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের। আর ময়লা অপসারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দেরি হওয়ায় তাদেরকেই দোষারোপ করছেন। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ময়লার স্তূপ অপসারণ সহজ কাজ নয়, এটা সহনীয় পর্যায়ে আনার কাজ সময়ের সাপেক্ষ কাজ হলেও সে সময়টুকুও দিতে অনেকেই রাজি নন। অথচ এক্ষেত্রে নাগরিকদের সকলেই কিছুটা দায়িত্বশীল হলে পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনগুলোর কাজ অনেকটাই সহজ হতো।
এই যখন অবস্থা আমাদের তখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজ মাঝেমাঝে আলোচনায় আসে। প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় তাদের সে স্বেচ্ছাসেবার জন্যে প্রশংসা পায় না; অনেকেই আড়ালে থেকে যায়। অথচ তাদেরকে প্রশংসা করা উচিত আমাদের। আমাদের এই প্রশংসা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো নিঃসন্দেহে।
এমন পরিস্থিতিতে এবার ব্যতিক্রমী এক কাজ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কক্সবাজার ইউনিট। তারা এবার ঈদের দিনে কক্সবাজার শহরে ময়লা অপসারণের কাজ করেছে। তরুণ এই সব ছাত্রদের অভিনন্দন, ধন্যবাদ আর ভালোবাসা; তাদের সেই কাজে উপকৃত হয়েছে সেখানকার অধিবাসীরা। সময়মত বর্জ্য অপসারণের কারণে পরিবেশ দূষণের যে ঝুঁকি ছিল সেটা কমেছে।
কক্সবাজারে কোরবানির পশু বর্জ্য অপসারণে যে কাজ করেছে বয়সে তারা তরুণ। এই বয়সে ঈদের দিন অন্যদের মত তাদেরও হয়তো ইচ্ছা ছিল ঘুরে বেড়ানোর, আনন্দ ফুর্তি কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর। কিন্তু সেটাকে তারা বিসর্জন দিয়েছে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্যে হলেও। এটা উল্লেখের মত এক ত্যাগ। কোরবানির যে শিক্ষা ত্যাগের সেটা তারা মানুষ, পরিবেশ ও নিজেদের শহরের জন্যে করেছে। তাদের এই কাজগুলো অনুসরণ ও অনুকরণীয় হোক, অন্য সকলের জন্যে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার ছাত্রলীগ সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ বলেন, ‘মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ব্যতিক্রমধর্মী কিছু কাজ করছে। কোরবানির ঈদের দিন পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েক কিলোমিটার সড়কে কোরবানির পশুবর্জ্য অপসারণ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর আগে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক পারাপারের জন্য সড়কে ১০টি জেব্রাক্রসিং স্থাপন করে ছাত্রলীগ। [প্রথম আলো, আগস্ট ২২, ২০১৮]
কক্সবাজার ছাত্রলীগের এই কাজটি যে অনুকরণীয় সেটা প্রমাণে একদিনের বেশি সময় লাগে নি। ঈদের পরের দিন ঢাকা দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি টিম একইভাবে কাজ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। দিনভর ঢাকা দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তারা ব্যাগ ও ব্লিচিং পাউডার বিতরণের পাশাপাশি বর্জ্য অপসারণেরও কাজ করে বলে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সমকাল।
এই দৃষ্টান্তের বাইরে সিলেটে অন্য এক কাজ করেছেন এক ছাত্রলীগ নেতা। এক গরু কারবারির চুরাশি হাজার টাকা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে সেটা প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সিলেট মহানগর ছাত্রলীগ নেতা সাঈদুল হক সাঈদকে এজন্যে সিলেটে মাইকিং করাতেও হয়েছে। এই কাজটি যে করেছে স্বাভাবিকভাবে সেও তরুণ এক। তার বয়সে একসাথে এতগুলো টাকা পেয়েও লোভ সংবরণ করেছে সে। তরুণ সে ছাত্রলীগ কর্মীর প্রতি তাই এক বুক ভালোবাসা। তার এই সততা মুগ্ধ করেছে আমাদের।
এই সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার খোরাক জুগিয়েছে। ছাত্রলীগ মানেই নেতিবাচক কিছু- এমন বিশ্বাসী লোকজন এই দেশে অধিক। সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা ও বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকাণ্ডে খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাখোশ এমনটাই কয়েকদিন জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অথচ এই সংগঠনটি বাংলাদেশের দুর্দিনে দেশবাসীর সাথে থেকেছিল, আলোর পথ দেখিয়েছিল। পথ হারানো সেই সংগঠনের সকলেই যে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ও সমালোচিত তা না, তবে বিক্ষিপ্ত সকল ইতিবাচক কর্মকাণ্ড নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের আধিক্যে আলোচনায় আসে না।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নামে-কাজে এমন স্বেচ্ছাসেবার কথা শব্দে-বাক্যে সরাসরি লিখিত না হলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামেই ‘স্বেচ্ছাসেবক’ শব্দটির উল্লেখ। সেবকের কাজ সেবা, এবং সেটা স্বেচ্ছায়। তবু এই সংগঠনটি অদ্যাবধি কী ধরনের ‘স্বেচ্ছাসেবকের’ ভূমিকা পালন করেছে সে ইতিহাস অজ্ঞাত।
দেশে বন্যাসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগেও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামক সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা যায় নি। একই কথা প্রযোজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্ষেত্রেও। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এবং ক্ষমতা ছাড়ার পর এই সংগঠনটিকেও দেশের প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা যায় নি। ফলে ধারণা করা যায়, এরা নামেই স্বেচ্ছাসেবক, কাজে নয়। জনকল্যাণে স্বেচ্ছাসেবা মুখ্য নয়, দলের একটা অংশ থেকে দল আর নিজেদের সেবাই হয়ত লক্ষ্য, এবং সেটা করতেই তারা টিকে আছে অদ্যাবধি।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ যে অনুকরণীয় কাজ করেছে সেটা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ থেকে প্রেরিত নির্দেশনা কিংবা সিদ্ধান্ত নয়। স্বপ্রণোদিত হয়ে করা এই কাজের জন্যে এককভাবে কৃতিত্বের দাবিদার সেখানকার স্থানীয় ইউনিট। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাদের নিয়ে গর্ব করতেও পারে, এবং এমন কাজের জন্যে বাকিদের অনুপ্রাণিতও করতে পারে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটা ‘ধন্যবাদ বার্তা’ তাদেরকে ভবিষ্যতে আরও অনেক ভালো কাজের সূচনা করতে পারে, একই সঙ্গে অন্য ইউনিটগুলো এধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করতেও পারে।
একবার ভেবে দেখুন, আগামিতে অন্য যেকোনো সময়ে এধরনের কিংবা অন্য কোনো জনহিতকর কাজে এভাবে দেশব্যাপী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নিজেদের নিবেদন করলে দেশের চেহারা পালটে যেতে খুব বেশি দিন লেগে যাওয়ার কথা না। এ ধরনের কাজগুলো কেবল নাগরিকদের পক্ষেই যাবে না, নিবেদিতপ্রাণ সকল নেতাকর্মী-সমর্থকদেরও কাজে লাগবে; শুদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা অর্জনে।
ছাত্রলীগের এই কাজ স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক- এ চাওয়াটা থাকবে। নামেই যারা স্বেচ্ছাসেবক তারা স্বেচ্ছাসেবা থেকে দূরে রয়েছে, কিংবা নিজেরাই জানে না স্বেচ্ছাসেবার গুরুত্ব। ছাত্রলীগের কক্সবাজার ইউনিট তাদের জন্যে শিক্ষাবার্তা নিয়ে আসুক; সারাদেশের স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক দল শিখুক কক্সবাজার ছাত্রলীগ থেকেই।
এইচআর/এমএস