ঢাকা আমার শহর
যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৮ সালের গ্লোবাল লিভেবলিটি ইনডেক্স বা বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতার সূচকটি নিয়ে আবার ভেবেছি। আমাদের রাজধানী ঢাকাকে যতই বাসযোগ্যতার বিচারে নিন্দা করা হোক, তবুও সে আমার শহর।
শহর ঢাকা আমার জীবনের প্রতিটির মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, তার পর চাকরি – সবইতো এখানে। এই শহরের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে জড়িয়ে আছি আমি। অনেক ভাল লাগার মুহূর্ত, অনেক পাওয়া-না পাওয়ার সময়।
আমাদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় সময়টায় ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম ছিল না। তাই এখনকার মতো দেশজুড়ে বা বিশ্বজুড়ে বন্ধু ছিল না। বন্ধু বলতে তারাই যাদের সাথে খেলা হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে, বনভোজন হয়েছে, জলে ঝাঁপ দেয়া হয়েছে। আমাদের ছোটবেলা আর বড় বেলার পৃথিবীটা এই ঢাকাতেই আবদ্ধ ছিল এবং আছে।
ঢাকার সঙ্গে একবার যে জড়িয়েছে সে তাকে আর ভুলতে পারে না। যেখানেই যাক, ঢাকার ভাষা, মানুষজন বা সংস্কৃতির কথা মনে রাখতেই হয়। ঢাকায় জীবনযুদ্ধের তীব্রতা হয়তো বেশি, কিন্তু এই শহরে এখনো এমন কিছু আছে, যা পৃথিবীর বহু শহরে নেই। এখনো এই শহরে কেউ অসুস্থ হয়েছে শুনলে, কারও মৃত্যু হয়েছে শুনলে ছুটে যায় একবারের কাছের মানুষতো বটেই, এমনকি সামান্য পরিচিতি আছে এমন লোকও চেষ্টা করে ছুটতে।
শত ব্যস্ততা আর অভাবেও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যায় শ্রদ্ধা জানাতে কোন বিশিষ্টজনকে। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ বিমানবন্দর থেকে শহীদ মিনারে নেয়ার আগেই মানুষের ঢলে এই শহর অচল হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর কোন শহর কোন লেখককে এমন ভালবাসা দেয়? ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচক দিয়ে কি শহরের এই মনন মাপা যায়?
দেশের বাইরে থাকলেও যে একবার এই শহরে কিছুকাল থেকেছে, তাকে ঢাকা নিয়ে ভাবতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশিদের কোনও সমাবেশেও ঘুরে-ফিরে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে ঢাকা তাদের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে থাকে। যে যেখানে থাকুক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি উপলব্ধিতে ঢাকাই জড়িয়ে আছে গভীর ভাবে।
আমি পরিশ্রম করেছি এই শহরে। এই শহরের মানুষ আমার সেই পরিশ্রম ও চেষ্টার শরিক, ব্যর্থ হতে হতেও যে সাফল্যের আভাসটুকু পাওয়া যায়, তার সহচর তো এই শহর। এই শহরই আমাকে দুঃখ-যন্ত্রণা ও সাফল্যের অনুভূতি ফিরিয়ে দেয় বার বার। আমি মানুষটা উল্লাসপ্রিয়। তাই আমি এই শহরকে নিয়ে ভাল আছি। মিশে গেছি শহরের সঙ্গে, মিশে গিয়ে গর্বিত হয়েছি।
আমার ছেলেবেলায় দেখা ঢাকা আর নেই। একটু একটু করে পাল্টেছে অনেক— কথায় বা বেশভূষায়। এখন চারিদিকে বড় বড় ফ্লাইওভার, বহুতল ফ্ল্যাট, সুন্দর সুন্দর বিশাল শপিং মল। কিন্তু, সার্বিক চরিত্রটা পাল্টায়নি একটুও— সেই প্রাণের স্পন্দনটা আজও একটু আছে যেন।
ঢাকার চরিত্রের এই স্বতন্ত্রতা সহজে বোঝা যায় কয়েকদিন ঢাকা ছেড়ে বাইরে গেলে। বড় উন্নত শহরে গিয়ে ঢাকার যানজট, স্থবিরতাকে গালি দিয়েও আবার মনে হয়েছে ঢাকাতো ঢাকাই। তার ভিড়, জ্যাম-জট, মিছিল, স্লোগান, বন্ধু, ক্রিকেট, ফুটবল, নাটক— সব কিছু নিয়েতো ভালই আছে ঢাকা।
অন্য অনেক শহরের তুলনা করলে ঢাকা মহানগরীকে নিচের দিকেই ফেলতে হবে। কিন্তু এই ঢাকায় যখন পহেলা বৈশাখে মানুষের ঢল নামে, যখন ঈদ আসে, যখন পূজার প্যান্ডেলে নতুন শাড়ির গন্ধ লাগে, তখন মনে হয় আর কোথাও নেই এমন প্রাণ।
বয়সে বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে যেতে দেখছি ঢাকা শহরটাকে। নব্বইয়ের দশকে হুড়মুড়িয়ে বদলে যেতে থাকল আমার অতি-পরিচিত এই শহর। একে একে পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে গজিয়ে উঠতে থাকল বহুতল। যার নাম এপার্টমেন্ট। ঢাকা এখন অনেক বড়। এখন সত্যি বলতে কী, এর সবটুকু চেনাও যায় না। মোহাম্মদুপুর চিনি, কিন্তু শেখেরটেক পার হয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে, টঙ্গি পেরিয়ে শহর কোথায় চলে গেছে, কিংবা যে সায়দাবাদকে অনেক দূরে মনে হতো, সেও এখন কত কাছে!
সব আমি চিনিনা। কিন্তু আমি চিনি এক শহরকে যে শহর বিশ্বকাপের উন্মাদনায় ঘুমায়না। এই শহর উৎসবের, এই শহরের আড্ডার, এই শহর মিছিলের, এই শহর বন্ধুত্বের। তাই সূচক যাই বলুক তবুও তা আমাদের শহর।
ভালবাসার কথা অনেক বলেছি। কিন্তু এই শহরকে আমাদের অমলিন রাখতে হবে। এর জৌলুস ফেরাতে হবে। তাই যানজটসহ যেসব কারণে বারবার ঢাকার বদনাম আমাদের বিদ্ধ করে রাষ্ট্র সেসব নিয়ে ভাবুক। আমরা নিজেরাও ভাবি কি করে আরও বেশি ভালবাসতে পারি আমাদের প্রিয় শহরকে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস