লাইসেন্স আছে?
‘আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?’ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়ে একদিনেই অনেক বার এই প্রশ্নটি শুনতে হয়েছে। যখন আন্দোলন চলে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম অফিসে যাতায়াতের জন্য। প্রথমে বাংলামোটরে পরে মতিঝিলে ও মোহাম্মদপুরে কয়েক জায়গায় প্রশ্নটি আমার ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে করা হয়।
পুলিশ বাহিনীর কোন সদস্যের কাছ থেকে এ জাতীয় প্রশ্ন শুনলে আতংক জাগে। মনে হয় এই বুঝি ঘুষ চাইবে, না পেলে অন্য কোনভাবে হয়রানির শিকার বানাবে। কিন্তু সন্তানসম কিশোর-কিশোরীদের কণ্ঠে এ প্রশ্ন শুনতে ভালোই লাগছিল। সরল বিশ্বাসে ওরা পথে নেমেছিল। ভেবেছিল এইভাবে সব কিছু ঠিক হযে যাবে। ওরা আন্দোলন করছে ঠিক সেই বিশ্বাসস নিয়ে, যে বিশ্বাসে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন স্কুল-কলেজের লাখো শিক্ষার্থী।
যে বিশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন লাখো কিশোর তরুণ। এরও আগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারাও অনেকেই এই বয়সী ছিলেন। শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর বয়স ওদের মতোই ছিল। শহীদ সূর্যসেনের দলে কিশোর বয়সীরা ছিলেন। অনুশীলন, যুগান্তর দলে এই বয়সীরাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রবল বৃষ্টিতে ওদের ভিজতে দেখে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল, ভয় হচ্ছিল ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে। একবার ভাবলাম আমার ছাতাটা ওদের হাতে দিয়ে দেই। স্নেহের যদি কোন অলৌকিক ক্ষমতা থাকতো তাহলে ওদের মাথার উপর আমি চন্দ্রাতপ দিতে পারতাম। তা না পারি, আশীর্বাদ করতে পারি নিশ্চয়ই।
সড়কে নৈরাজ্য দূর করতে ওরা পথে নেমেছিল। ওদের দাবি নিরাপদ সড়ক। শত শত কিশোর কিশোরী, তরুণের মুখে যে দৃঢ় প্রত্যয় দেখেছি, যে সততার আলো দেখেছি তা দেখার পর আমি বাংলাদেশকে আবার নতুন করে ভালোবাসছি। ওরা সড়কে দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যা বন্ধ করতে চায়, ওরা সড়কে একজন মন্ত্রীর নির্দেশে ও আশকারায় ক্রমবর্ধমান গুন্ডামি প্রতিরোধ করতে চায়।
লাইসেন্সবিহীন, ফিটনেসবিহীন বাস, গাড়ি এবং অদক্ষ, বেপরোয়া চালক দুর্ঘটনার মূল কারণ। তবে সত্যি কথা বলতে কি এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। পরিবহন ব্যবসার আড়ালে মাদক পাচার, অবৈধ অস্ত্র পাচার ইত্যাদি বিষয় জড়িত। পরিবহন মালিকদের সিন্ডিকেটে রয়েছে সমাজের উপর স্তরের এবং ক্ষমতার ছত্রছায়ায় আসীন অনেক রাঘব বোয়াল।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বহু নেতা-পাতি নেতার স্বার্থ দেখছে ওইসব বেপরোয়া চালক, সুপারভাইজাররা। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ তো সাপ তিমি মাছও বেরিয়ে আসবে।
‘সম্রাটের নতুন পোশাক’ গল্পে বড় বড় বুদ্ধিজীবী, আমলা আর উজির নাজিররা সম্রাটকে বলার সাহস পায়নি যে সে উলংগ। কিন্তু একটি শিশু অকপটে সে কথা বলতে পেরেছিল। আমাদের শিশু কিশোররাও অকুতোভয়ে সড়কের প্রকৃত নৈরাজ্যজনক অবস্থা এবং বড় বড় রথীদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। পুলিশের গাড়িরও যে লাইসেন্স নেই সে কথাটি দেখিয়ে দিয়েছে। মন্ত্রীর গাড়িকেও থামিয়ে দিয়েছে তারা।
হে শিশু, কিশোর, তরুণ তোমরা দেখিয়েছো অহিংস আন্দোলন কাকে বলে। তোমরা দেখিয়েছো ৪৭ বছর পর ঢাকায় ইমার্জেন্সি লেন চালু করা সম্ভব। তোমরা সব চক্রান্তকে প্রতিহত করতে পেরেছো। তোমাদের স্যালুট। আমাদের মানে অভিভাবকদেরও কিছু করণীয় আছে। আমাদের উচিত তোমাদের এই আন্দোলনের স্পিরিটকে ধরে রেখে সড়কের সকল অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
সরকারের উদ্দ্যেশে দুটি কথা। এই আন্দোলন ‘সরকার বিরোধী’ ছিল না। এই আন্দোলন শুভ, সামাজিক আন্দোলন। যারা সরকারে আছেন তারা আসুন, এই সামাজিক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিই। সড়কে তো আমরা সকলেই চলাচল করি। সড়কটা নিরাপদ হলে সরকার-অসরকার সকলের জন্যই তো ভালো।
সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সর্ষের মধ্যে প্রচুর ভূত রয়েছে। অবশ্য ভূত তাড়ানোর একটি মন্ত্র আমি রপ্ত করে নিয়েছি। আমার এখন এই প্রশ্নটি করার সাহস জন্মেছে ‘আপনার লাইসেন্স আছে?’
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস