শোক থেকেই শক্তি ও আলোর অভিযাত্রায় যেতে হবে
‘আগস্ট শোকের মাস, পাপমগ্ন, নির্মম-নিষ্ঠুর,
তাকে পাপ থেকে মুক্ত করো কান্নায়, কান্নায়।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’ কবিতাটি শেষ করেছেন ওপরের চরণ দুটির মাধ্যমে। প্রকৃতই আগস্ট বাঙালি জাতির কাছে এক গভীর বেদনার মাস, নিরবে কান্নার মাস, তীব্র প্রতিবাদের মাস। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও আগস্ট মাসের পৈশাচিক নির্মমতার এক রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
কারণ, হাজার বছরের শাসন-শোষণ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাঙালি জাতিকে যিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এনে দিয়েছেন, এনে দিয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই আগস্টেই এদেশের ক্ষমতালোভী কিছু মানুষরূপী নরপিশাচ রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ঘাতকেরা যে কেবল একক ব্যক্তি বা নেতা বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেছিল তা নয়- তারা হত্যা করেছিল বিশ্ব ইতিহাসে বিরল মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সকল স্বপ্নবান রাজনৈতিক আদর্শকেও। ঘাতকেরা হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের আঠারো সদস্য। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের অমিত সম্ভাবনাময় এই নেতাকে এভাবে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীর ষড়যন্ত্র তা ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রকাশ পেয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরই ওৎ পেতে থাকা ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী তার মিত্রদের সঙ্গে যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়- তার সকল উত্তরসূরীদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের সূর্যোদয়ের ঠিক আগে আগে। বিদেশে অবস্থানের কারণে ভাগ্যক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোটবোন শেখ রেহানা ঘাতকের আক্রমণ থেকে নিজেদের জীবন রক্ষায় সমর্থ হন।
ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তানি আদর্শ প্রবর্তনসহ পাকিস্তানি আনুকূল্যকে নিজেদের প্রেরণা ও উৎসাহ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে, একটি স্বাধীন জাতির পুনরায় পশ্চাৎমুখী যাত্রায় পথচলা শুরু হয়। বাঙালির দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্থলে সাম্প্রদায়িকতা পুনরায় বাসা বাধে। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অস্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন করা হয়। অযাচিত সামরিক হস্তক্ষেপে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধান ছিন্নভিন্ন হতে থাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে।
সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা শুধু একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা ছিল না- তা ছিল বাঙালির সামগ্রিক আদর্শকে হত্যা করা এবং তার মধ্য দিয়ে পুনরায় আমেরিকার তাবেদার রাষ্ট্র পাকিস্তানে পরিণত হওয়ার এক ভিন্নতর মহড়াও! যেমনটি আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিনই জুলফিকার আলী ভূট্টো উভয় দেশের মধ্যে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইমানদার বাঙালি মুসলমানদের (!) সাহায্যার্থে খন্দকার মুশতাককে বিভিন্ন উপঢৌকনও পাঠিয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভূট্টো- এক সপ্তাহের মধ্যেই।
কিন্তু যে আদর্শ ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং যা দীর্ঘ দিনের অনুশীলনে গড়ে ওঠা তার মৃত্যু ঘটাতে পারে এমন শক্তি ষড়যন্ত্রকারীদের থাকে না। কালক্রমে ঐতিহাসিকভাবে সেই সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আজো তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরই আদর্শের ওপর ভিত্তি করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার কাজও চলছে নিরন্তর।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির মনন তৈরি করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ দিনের সংগ্রামী জীবনের সাধনায়। শৈশব-কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধু মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ক্রমে বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা হয়েছে ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর। তারপর তাঁর জীবনে ঘরের চেয়ে আপন হয়ে উঠেছিল এদেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ ও তাদের অন্তহীন সমস্যা ও সংকট।
মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের ঘরের চেয়ে জেলখানাতেই বঙ্গবন্ধুর সময় কেটেছে অধিক। রাজনীতি আর রাজনীতি, মানুষের জন্য রাজনীতি, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনীতি- রাজনীতিই ছিল তাঁর জীবনের সাধনা। নানা ঘটনার চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা এবং অন্তহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন, এদেশবাসীর জীবনে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন।
বাঙালি তাঁকে ও তাঁর দলকে আপন করে নিয়েছিল সেদিন। সমগ্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে আপন করে নিলেও পাকিস্তানিদের আসন হয়ে উঠেছিল টলটলায়মান। তারা নানা বাহানা, অজুহাত আর ষড়যন্ত্রের পর পর ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছিল। পরিবর্তন করে যাচ্ছিল এসেমব্লি অধিবেশনের দিন তারিখ।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিজয়ী দলের সংসদ সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক কেবল কালক্ষেপণ আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। এরই মধ্যে দিয়ে আসে বাঙালির জীবনে মার্চ, উত্তাল মার্চ, আসে সাতই মার্চ। আগস্ট এলে আমাদের মনে ৭ই মার্চের সেই ভাষণও মূর্ত হয়ে ওঠে। যে ভাষণ স্বাধীনতার অভিমুখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কয়েক ধাপ!
১৯৭১ সালের সাতই মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবনের রাজনৈতিক বক্তব্য-ভাষণ থেকে সেদিনের অর্থাৎ ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল ভিন্নতর। এদিনের ভাষণ ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে অনুপ্রাণিত করে তোলার আহ্বান।
বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ভাষণ আজ আর কেবল বাঙালি নয়- তাবৎ বিশ্বের সকল শোষিত মানুষের অনুপ্রেরণা ও আশ্রয়। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ হিসেবে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ায় তা আজ বিশ্বসম্পদে পরিণত হয়েছে।
সাতই মার্চের উত্তাল বিকেল আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণকে কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো গভীর আবেগ কিংবা বাস্তবভঙ্গিতে দেখেছেন বা উপলব্ধিও করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নেই। ‘স্বাধীনতা’ এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ কত সহজভাবে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমাদের উপলব্ধির জগৎকে আলোড়িত করেছেন। কবিতার শেষ ক’টি চরণে তিনি লিখেছেন :
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো।
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা আর স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে তেমন কালিক কোন ব্যবধান ছিল না। অল্পদিনের মধ্যেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। একদিকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা-পুলিশ-সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সংগ্রাম অপরদিকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে বন্দি বাঙালির প্রিয় নেতা।
জেলের ভেতর কোর্ট মার্শাল-এ একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টাসহ কবরও খোড়া হয়েছিল। অথচ অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারলেও তাদেরই এদেশীয় বশংবদেরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে তাঁকে হত্যা করে!
বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতাকে এভাবে হত্যা করায় সারা পৃথিবীর সভ্য দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসররা মেতে উঠেছিল পৈশাচিক উল্লাসে। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অপর সদস্যদের লাশগুলোও মৃতের প্রকৃত শ্রদ্ধাটুকু থেকে হয়েছে বঞ্চিত। অবর্ণনীয় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর লাশ পাঠানো হয়েছিল তাঁর জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানেই তিনি শায়িত হন চিরনিদ্রায়।
যেখানে তাঁর শৈশব-কৈশোর ও বেড়ে ওঠা, যেখান থেকে মানুষের সাথে সম্পর্ক রচনা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিস্তৃত পটভূমি তিনি লাভ করেন বাইগার নদী পাড়ের সেই টুঙ্গীপাড়ায়। টুঙ্গীপাড়ার তৎকালীন পরিবেশ সম্পর্কে শেখ হাসিনা যেমন ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ নিবন্ধে লিখেন : ‘বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মত সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গীপাড়া।
বাইগার নদী এঁকে-বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতি নদীতে। এই মধুমতি নদীর অসংখ্য শাখার একটি বাইগার নদী। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালী গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে।’
অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির কোলে শায়িত বঙ্গবন্ধু। এখন নিয়মিত সেখানে হাজারো মানুষের ভিড় জমে- তারা দীক্ষা ও ব্রত গ্রহণ করে সমাধি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়বার। বঙ্গবন্ধ সমাধি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে অশ্র“ বিসর্জন করে শ্রাবণের ধারার মতো। যেমনটি বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন :
আজ উৎপাটিত বটপত্রের শুভ্র-কষের মতো
চোখ বেয়ে ঝরুক তোমার অশ্র“বিন্দুরাশি।
আজ কাটা-খেজুর গাছের উষ্ণ রসের মতো
বুকের জমানো কান্না ঝরুক মাটির কলসে।
আগস্টের শোক অন্তহীন। তবু, আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যেতে হবে। সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে বাঙালির শত্রু“ বিশেষত আওয়ামী লীগের শত্রু“ সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে- এই শত্রু“ শরীরি এবং ভার্চুয়াল উভয় ধরনের। শুধু সংখ্যায়ই নয়- কৌশলেও তারা আগের চেয়ে হয়েছে চালাক ও চতুর। সুতরাং শত্রু“র মোকাবেলা করতে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদেরও নানাভাবে হতে হবে আরো চৌকস, আরো স্মার্ট। বুদ্ধিমত্তা, শক্তি ও কৌশলে সকল অপশক্তিকে পুনরায় পরাজিত করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।
আগস্টের শোককে বহন করার ধৈর্য্য নিয়ে শক্তিও সঞ্চয় করতে হবে- একথা ভুলে গেলে চলবে না। সমগ্র বাঙালিকে নিয়ে অমিত আলোর অভিযাত্রায় পৌঁছুতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেই শক্তির উৎস ধরে এগুতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস