ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শোকাবহ ১৫ আগস্ট : উল্টোরথ যাত্রার পাক-মার্কিন প্রয়াস

শফী আহমেদ | প্রকাশিত: ০৮:৩৬ এএম, ১৫ আগস্ট ২০১৮

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রে ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাঁপটি মেরে থাকা একাত্তরের পরাজিত দালালদের সহযোগিতায় একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এরই মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই মহান নেতার সমগ্র জীবনের লালিত স্বপ্ন সাধকে ধূলিস্যাৎ করে পুনরায় বাংলাদেশকে উল্টোরথ যাত্রায় মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়।

খুনিচক্র কস্মিনকালেও ভাবেনি বাঙালি জাতির রক্তে বীরের শোণিত প্রবাহিত। যে রক্ত কোনদিন পরাভব মানে না। অনেক রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা। এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সামরিক শাসনকে উচ্ছেদ করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

আমাদের ধারণা এরকম ছিল, সামরিক জান্তা যে ফরমান বলে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলো তা রদ করতে হলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এই ধারণা ছিলো নিতান্তই ভুল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সমর্থ হয়। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রচলিত আইনে নিয়মতান্ত্রিক পথে।

হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ওই বছরের ১২ মার্চ ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে শুরু হয় বিচার। একই বছর ৭ এপ্রিল ওই আদালত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। মারা যাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েন মোশতাক আহমেদ, মাহবুবুল আলম চাষী ও মোস্তফা আহমেদ। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। আসামিপক্ষের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট উক্ত মামলায় বিভক্ত রায় দেন। অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়ে যে, এই মামলা শুনানির সময় হাইকোর্টের কোনো কোনো বিচারপতি নির্লজ্জভাবে মামলা শুনানির ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করে দেশবাসীকে বিব্রত করেন। দ্বিধাবিভক্ত রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন।

অপর বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। তৃতীয় বিচারপতির রায়ের বিরুদ্ধে ৫ আসামি আপিল করে। কিন্তু ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দী ৫ আসামির দায়ের করা পিটিশন খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ আদেশের ফলে দণ্ডিতদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোনো আইনগত বাধা থাকল না। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে গঠিত আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ রিভিউ খারিজ করে দেন।

অনেক রক্তক্ষরণ ও অগণিত মানুষের আত্মদানের পটভূমিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃতাধীন মহাজোট। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে। উন্মোচিত হয় আইনের শাসনের নতুন দুয়ার।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’-এ অঙ্গীকার ছিল নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তাই ঘটেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট ২৯ কার্যদিবস হাইকোর্টের রায়ের পেপারবুক পঠন, শ্রবণ এবং আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের সওয়াল জবাব শোনার পর ১৯ নভেম্বর ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে।

নিষ্ফল প্রাণভিক্ষার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি আসে সেই শুভ লগ্ন। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তি ঘটে। যার জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ ৩৪ বছর। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা তালিকার মধ্যে ছিল কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল এ কেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (লেন্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী পলাতক আসামিরা কে কোথায়? ছয় খুনির মধ্যে লে. কর্নেল এসএইচবি নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় এবং লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে আমেরিকায় পলাতক। নূর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। পলাতক খুনিদের মধ্যে চারজন লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল আবদুর রশীদ, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য আছে কী না তা আমাদের জানা নাই। অপর এক খুনি মেজর পাশা পলাতক অবস্থায় ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে।

শোককে শক্তিতে ধারণ করার নিমিত্তে প্রতি বছর বিনশ্র শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সেই কালরাত্রিতে জনক ও তাঁর পরিবারের যারা বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাঁদেরকে জাতি স্মরণ করে। কিন্তু আমরা এও আশা করি যে, কূটনীতিক তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হোক। পৃথিবীতে যে সমস্ত দেশগুলো মানবতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে স্ববিরোধী-সংবেদনশীল আচরণ করে তাদের উচিৎ এই খুনিদের বাংলাদেশের হাতে প্রত্যার্পণ করে তাদের স্ববিরোধিতার অবসান ঘটানো।

বঙ্গবন্ধুর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শৈশব থেকেই তিনি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখরিত ছিলেন। সেই প্রতিবাদের ধারা বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবনেও অব্যাহত ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রাবস্থায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দলনে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বহিস্কৃত হন।

মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি সামনে কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন। এই মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারা সূতিত হয়। বায়ান্ন থেকে ১৯৬৯ এই কালপর্বে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রতিবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত স্বপ্নকে মূর্ত করে তুলেন।

সেসময়ে তিনি কখনো জেলে কখনো জেলের বাইরে। মুক্তি পাগল বাঙালি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখ মুজিবর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। আবার বঙ্গবন্ধুকে যখন জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় তাও সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সানন্দচিত্তে মেনে নেয়। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলিতে বঙ্গবন্দুর তর্জনী যেদিকে ঘুরেছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেদিকে ঘুরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জাতিগোষ্ঠির এমন নেতৃত্ব বিরল। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, তাই তিনি জাতির পিতা, তাই তিনি শেখ মুজিব, তাই তিনি হিমালয়সম।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানী হায়েনাদের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর মৃত্যর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিঃসঙ্গচিত্তে বজ্রকণ্ঠে খুনিদের প্রশ্ন করেছিলেন ‘এই তোরা কারা? কি চাস?

বঙ্গবন্ধুকে বারবার সতর্ক করার পরও তিনি কোনদিনই ভাবতে পারেননি কোন বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস বঙ্গবন্ধুর স্নেহের লালিত পালিত বেইমান কুলাঙ্গার খুনিরাই বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে।

এখানে শুধু খুনিদের কার কি বিচার হয়েছে সেই বিবরণ দেয়া হল। কিন্তু আমাদের জোর দাবি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার প্লট যারা তৈরি করেছে এবং এর নীলনকশা যারা বাস্তবায়ন করেছে তাদের সমূলে চিহ্নিত করা দরকার। সরকার বিভিন্ন সময় এদের চিহ্নিত করবার কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিশন গঠন করেনি।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাঙালী জাতির জন্য ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন, সাম্যবাদী, মানবিক বাংলাদেশ। জাতি আশা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি যেন আপোসহীনভাবে এগিয়ে যান।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের আপোসহীন বাস্তবায়নের পথেই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে জাতির অপূর্ণ আশা পূরণ হতে পারে। এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কোন ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারাকে ব্যাহত করতে পারবে না। কারণ, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির নায়ক হিসেবে বেঁচে থাকবেন, যতদিন পৃথিবী বেঁচে থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যয় হোক একটি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, আইনের শাসনের ধারা বজায় রেখে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন