‘শিরোনাম জাদুকর’ সারওয়ার ভাই
পবিত্র কাবা শরিফ চত্বরে বসে এক সময়ের যুগান্তর, বর্তমানে সমকাল সম্পাদক শ্রদ্ধেয় গোলাম সারওয়ার ভাইর মৃত্যু সংবাদটা পেলাম। হঠাৎ করেই মনটা কেঁদে উঠলো।
আহা, সারওয়ার ভাই আর নেই! চোখের সামনে ভেসে উঠলো আনুমানিক ১৫-১৬ বছর আগের কথা। সেই সময় খুলনার দুই জোড়া যমজ শিশুর অস্ত্রোপচার নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড়। যুগান্তরের স্বাস্থ্য বিটের রিপোর্টার হিসেবে জোড়া লাগানো শিশুর চিকিৎসা-সংক্রান্ত খবরের ফলোআপের দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর।
যুগান্তরের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম ভাই তখন চিফ রিপোর্টার। সাইফুল ভাই ডেকে বললেন, সারওয়ার ভাই সিরিয়াসলি ফলো করতে বলেছেন, এটুকু বলার পর যা বোঝার বুঝে ফেললাম। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল সরেজমিন মতিঝিলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চা দুটির ফলোআপ রিপোর্ট করি, কবে অস্ত্রোপচার হবে তা জিজ্ঞাসা করি।
একদিন অধ্যাপক জানান, কাল বেলা ২টায় অপারেশন হবে। সময় লাগবে তিন ঘণ্টারও বেশি। পরদিন দিনভর পরিশ্রম করে অস্ত্রোপচার-সংক্রান্ত সব রিপোর্ট নিয়ে অফিসে এসে লিখতে বসে গেলাম। কোনো তথ্য যেন বাদ না পড়ে এ চিন্তা করে সময় নিয়ে লিখলাম।
কাজের চাপে দুপুরে খেতে পারিনি। তাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাইফুল ভাইয়ের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়ে অনুমতি নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। যুগান্তরের তৎকালীন মতিঝিল অফিস থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে আসতেই সাইফুল ভাইয়ের ফোন, ‘তুই কই? তাড়াতাড়ি অফিসে আয়, সারওয়ার ভাই তোকে খুঁজছে।’
পড়িমড়ি করে অফিসে এসে সারওয়ার ভাইয়ের কক্ষে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে দেখি উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে স্লিপ প্যাডে লেখা আমার রিপোর্ট পাতা উল্টিয়ে দেখছেন। অদূরে সোফায় ভাবি বসে আছেন।
সারওয়ার ভাই আমাকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বললেন, ‘তুমি রিপোর্ট দিয়ে চলে গেলে কেন? কি ইন্ট্রো লিখেছ? আমি কি তোমার পোকা (উনার মনঃপূত হয়নি) বাছতে বসেছি। কি লিখেছ, আবার বাই লাইন দিয়েছ’- বলেই গজ গজ করে কলম দিয়ে নাম কেটে দিয়ে কিছু তথ্য নোট করে আমাকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বললেন।
রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই কান্না পেলো। কোনো রকমে কান্না লুকিয়ে বাসায় চলে এলাম। পথে আসতে আসতে গত কয়েকদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা মনে করে কষ্ট পেলাম। রাতে বাসায় ফিরেও মন খারাপ করে ঘুমাতে গেলাম।
সকালবেলা মোবাইলে ফোনের পর ফোন। যেই ফোন করে সেই বলে, অসাধারণ রিপোর্ট লিখেছ? কি দারুণ হেডলাইন 'অপারেশন সাকসেসফুল'। কি সুন্দর ইন্ট্রো, ছবি।
ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড়ে যুগান্তর দেখে আরেকবার চোখের কোণা ভিজে উঠলো। তবে এবার কান্নায় নয়, আনন্দে। লাল কালিতে চার কলাম হেডলাইন, বাই লাইনে আমার নাম। স্টোরির দুপ্যারা সারওয়ার ভাই নিজে লিখে দিয়েছেন। হেডলাইনও তারই করা।
এই হলো সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। যিনি কাজের সঙ্গে কখনো কম্প্রোমাইজ করতেন না। তিনি বলতেন, রিপোর্টারের রিপোর্টে ঘামের গন্ধ না থাকলে সেটা রিপোর্ট হয় না। তিনি ছিলেন শিরোনাম, ইন্ট্রো ও নিউজ এডিট করার জাদুকর।
তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পবিত্র কাবা শরিফে দোয়া করেছি।
আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন প্রিয় সারওয়ার ভাই।
লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, জাগো নিউজ২৪ ডটকম। সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর।
এইচআর/পিআর