ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আবালত্ব থেকে মুক্তি হোক

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ০৭ আগস্ট ২০১৮

চারপাশে ফিসফিস ফুসফাস। গলা খুব নামিয়ে টুকরো কথা। মুখে না বলে চোখের ইশারা কাজে লাগাতে বেশি আগ্রহ। হাতে ধরা পানির বোতল। একটু পরেই ঢালতে হচ্ছে গলায়। সাহারা মরুভূমি হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এসে বসেছে গলার ভেতর। দ্রুতবর্ধনশীল সাহারা এখন বুক-পেট ছাড়িয়ে নীচে ধাবমান। ব্লাডারে চাপ দেয় ঘন ঘন। বার বার বন্ধ হয় দরজা, টয়লেটের। নিজেকে মুক্ত করার কী আকাঙ্খা বাহে!

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়ে ফেলা যায় সহজেই। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নির্মাতার খোঁজ করছে, যে কোন সময় দাঁড়াবে মুখোমুখি, ভাবা যায় সহজে? আতংক সর্বগ্রাসী হলে সাহারা বীজ বোনে এভাবেই। দরজায় কড়া নাড়তেই কেঁপে ওঠা, কপালের ঘাম ঝরে যায় ঠোঁটের লালায়। এভাবে তাড়া খেতে হবে, ভেবেছে কে কখনো?

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে। তা-ই তো জানা আছে চিরায়ত সত্যের মোড়কে। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা। ভাব সম্প্রসারণে এ পিতা সেই পিতা নয়, এ নাকি শিশুর ভবিষ্যৎ, থুক্কু এ কালে যে পিতা তার ভবিষ্যৎ হবে যে শিশু, বয়ান তারই।

ঘুমিয়ে আছে বলে চোখে ভাসে দোলনা, বেবি ক্রিব, নিদেন পক্ষে তুলতুলে ফোমের বিছানা। ঘুমিয়ে আছে শিশু, যে কিনা পিতা হবে ভবিষ্যতে। ঘুমাক। বর্তমানে যে পিতা (এবং মাতা), সে এতকাল নিশ্চিন্তে মানস-খাটে শিশুকে ঘুমন্ত দেখেই অভ্যস্ত। আর তাই পুতুলের মতো ফোলা ফোলা গাল টিপে আদর করা, হরলিক্স না বুস্ট তর্কে মেতে ওঠা, ইংলিশ মিডিয়াম না ভার্সন নির্বাচনে হিমশিম খাওয়া, কোচিং-কুইনাইন আর গাইড-থেরাপি দিতে পারলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো সহজ কাজকেই দুর্দান্ত দরকারি বলে ভেবেছে। ফোলা ফোলা গাল দুই হাতে জোর দিয়ে টিপে এর ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে হরলিক্স-বুস্ট-কোচিং-গাইড-মিডিয়াম-ভার্সন-হাবিজাবি-আবাজাবা।

হাতের শক্তিতে শিশুর দুই পায়ের মাঝখানে বিকৃত যৌনানন্দ খুঁজতে খুঁজতে অপূর্ণাঙ্গ যৌনাঙ্গে গাছের গুঁড়ি ঠেসে দিতে পারার মতো ক্রিয়েটিভ যে পুর্ণবয়স্ক আবালরা, নিদেন পক্ষে রুচি পাল্টানোর বাজার চড়া বলে শিশু পর্ন দেখতে এবং দেখাতেও আগ্রহের কমতি নেই যে আবাল সমাজ, চার বছরের গৃহকর্মীকে মরার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার শক্তি ধরে যে আবাল শ্রেণি, বাচ্চারা কিস্যু বোঝে না আর আমরাই সব বুঝি বলে গাঁট হয়ে বসে থাকা আবাল সিস্টেম হঠাৎ দেখতে পেয়েছে, বনসাঁইয়ের শরীরে যেভাবে বেড়ে ওঠে বটগাছ, সেভাবে শিশুর শরীরে অসময়ে জেগে ওঠা শিশুর পিতা বুক টান টান করে গর্জে উঠে বলছে, বিচার চাই! বিচার! 

শিশু-কিশোর মৃত্যু প্রতিদিনকার খবর হয়ে ওঠে যখন, তখন আবাল উক্তি কেবলি ‘কী যে সব হচ্ছে’। এখন জেগে ওঠা কচি কণ্ঠ প্রশ্ন হেঁকেছে, বিচার চাই। ঘরে খাবার নেই আর রাজার প্রাসাদে ভোজ চলছে, এই খবর পেয়ে ফরাসী বিপ্লব জন্ম নিয়েছিল কোন সুনির্দিষ্ট নেতা ছাড়াই। বিক্ষুব্ধ মানুষ, ক্ষুধার্ত মানুষ নিজেই নিজেকে ছুটিয়ে এনেছিল রাজপথে। ঘুমিয়ে থাকা শিশু সহপাঠী হত্যার বিচার চাইতে যখন রাজপথে নেমে এল, তখন হাজারো ক্ষোভ মিশে গেল এক বিন্দুতে। 

আহারে কৈশোর! কীভাবে কোন্ প্রতিবাদ করতে হয়, এখনো শেখেনি। কোন্ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া কীভাবে করতে হয়, তা সুনির্দিষ্ট করতে কিশোর-মস্তিষ্কের সার্কিট এখনো সুবিন্যস্ত হতে পারেনি। যে বয়সে বোকা জুলিয়েট বিষ খায় আর রোমিও বুকে বসায় ছুরি, সে বয়স পার করে আর কয়েক বছর গেলেই কিন্তু বেঁচে যেত ওরা, তবুও অপেক্ষায় থাকে না সে বয়সের। বিচার চায় ওরা, বিচার।

প্রতিবাদের ঠিকঠাক ভাষা শেখাতে আবাল শেখানোওয়ালারা লাঠি তোলে, রক্তাক্ত করে ছোট শরীরগুলো। ভুলে যায়, ছোটরা কিন্তু ভোলে না কিছুই। শতকরা সাতাশি ভাগ কাজ ওরা শেখে দেখে দেখে। আবালের আবালত্ব শিখিয়ে দিচ্ছে যা, তার প্রয়োগ শিশু যখন পিতা হবে, তখন ঘটাবে কি? মনে রাখতে হবে, এই আবাল কিন্তু তখন আরেকটু বুড়ো হবে, নড়বড়ে হবে, শক্তিহীন হবে।

লাঠির প্রতিদান ফুল দিয়ে হবে, সেই আশা থাকলে ঈশপের কাছ থেকে কথা ধার নিয়ে শুরু হোক কপচানি। ছোটদের কাজ বড়োদের মুখে মুখে তর্ক না করা, বড়দের প্রতি সদয় হওয়া, যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন প্রয়োজনে কেবলি ব্যবহৃত হতে দেওয়া। শুরু হোক ঠাকুরমার ঝুলি পাঠ। বড়দের প্রতি দায়িত্ব পালন না করলে বড়দের অভিশাপে পোড়ে হবি খাক, কেননা অভিশাপ কেবলি বড়রাই দিতে পারে, আইনতঃ এ অধিকার চিরকাল বড়দেরই।

ফিসফাস-সাহারা-নড়োবড়ো হাঁটু, শুনেছে সব। বিচার চায় ওরা। এতকাল ধরে যে আবাল সিস্টেম আর আবাল সমাজ ‘বাচ্চাদের ভালোর’ নামে দাঁড় করানো ছিল, তার গোড়া ধরে টান মেরেছে বাচ্চারা। এরপর কি হবে? ওরা বিচার চাইতে শিখে গেছে। এরপর আর কোন্ কোন্ বিচার ওরা চাইবে?

স্কুলে পড়ানোর কথা থাকলেও না পড়ানোর বিচার, অপত্য স্নেহের বদলে বিনিয়োগ-মুনাফার ছকে ফেলে জিপিএ ফাইভ নামক আবাল সিস্টেমের বিচার, বাবার হাত থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়ার বিচার, খোলা মাঠে খেলতে না দেওয়ার বিচার, বড় হয়ে হাতিঘোড়া হতেই হবে বলে টাকার মেশিন বানিয়ে ফেলার বিচার, হাজারো কষ্টে মায়ের কাছে মন খুলে কথা বলতে না পারার বিচার, বাবাকে বন্ধুর মতো পাশে না পাওয়ার বিচার,

ঠাণ্ডা মাথায় মাদকের ব্যবসার লাভ উঠাতে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো মাদকাসক্ত বানিয়ে ফেলার বিচার, এরকম হাজারো বিচার চাই-এর ক্ষেত্র তো টসটসে হয়েই আছে, কেবল ঝরে পড়ার অপেক্ষা। দরজায় নক্ পড়তেই তাই কাঁপাকাপি, কে জানে কখন এসে পড়বে সামনে, বিচার চাইবে।

নিরাপদ সড়ক চাই, এ এক আন্দোলনেরই নাম, যা কখনো সমাধানের মুখ দেখতে পারেনি। এত এত মাথা, আবাল যদি না হ’ত, এতোকাল কি পারতো না সড়ক সত্যিই নিরাপদ করতে? গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো কি পুলসিরাত পার করানোর মতো কঠিন কাজ? চালকের লাইসেন্স ঘুষ না খেয়ে ঠিক মতো দিতে পারার সিস্টেম গড়ে তোলা কি সত্যিই খুব কঠিন কাজ?

মোটেও না। তবে কথা আছে অবশ্যই। যে দেশের গাছের পাতাও ঘুষ চেনে, যে দেশের মানুষ সিস্টেম মানেই ঘুষ খাওয়া বোঝে, যে দেশে মসজিদেও ঘুষের টাকার লেনদেন হয়, সেখানে সিস্টেম আবাল হবে না তো কি হবে?

দেশ তো একজন কারোর নয়, কচি বাচ্চারা যেভাবে একসাথে পথে নেমে বিচার চায়, রিক্সা লাইন ধরে চলতে বাধ্য করেছে, বাসচালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আবালত্ব থেকে মুক্তির উপায়, সেভাবে আবাল বড়োরা একসাথে কেন বলে না, বাচ্চাদের ভালোর জন্যই এই মুহূর্ত থেকে আমি আর আবাল থাকবো না? কেন বলে না?

ফিসফাস-সাহারা-নড়োবড়ো হাঁটুর আবালেরা, কেবল কি শুনবেনই? বাচ্চাদের সাথে পথে নেমে আসার কষ্ট আবাল শরীর সইতে নাও পারে। তাই ঘরে বসেই সিদ্ধান্ত নিন্ না, এই মুহূর্ত থেকে আমি আর আবাল থাকবো না। দেখবেন, ঠিক এর পরের মুহূর্তেই সড়ক নিরাপদ হবে। শুধু কি এই? মীমাংসিত হবে সব সমস্যার। এর জন্য প্রয়োজন শিশু নয়, শিশুর পিতা এবং মাতাকে একসাথে প্রতীজ্ঞা করা। শিশুর সত্যিকারের ভবিষ্যতের জন্য এই কাজটি করা কি আসলেই খুব কঠিন?
মোটেও না।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন