ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পাক প্রধানমন্ত্রীর মুখ না মুখোশ হবেন ইমরান?

অঘোর মন্ডল | প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ২৯ জুলাই ২০১৮

 

ক্রিকেটার ইমরান খানের ভাবমূর্তির পাশে রাজনীতিবিদ ইমরান খানকে রাখলে ভুল হবে। বাইশ গজের ইমরান খানকে দেখা চোখ দিয়ে রাজনীতিবিদ ইমরানকে দেখলে শুধু ভুল হবে না। মস্তবড় ভুল হবে। ক্রিকেটার ইমরান স্বতন্ত্র। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বতন্ত্র।

দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন স্বৈরতন্ত্র। একক ক্ষমতা ছিল তাঁর। আর ইমরানের মনোভাবটা খুব পরিষ্কার ছিল। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা না পেলে তিনি ক্যাপ্টেন ইমরান খান হয়ে উঠতে পারতেন কী না সন্দেহ। তার ক্রিকেটীয় সাফল্যের যা রেসিপি সেটা পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে অনেক বেশি মানিয়ে গিয়েছিল।

স্বৈরতন্ত্রের যদি কোন ইতিবাচক অর্থ খোঁজার চেষ্টা হয়; তাহলে ক্রিকেটার ইমরান, ক্যাপ্টেন ইমরান খান তার দুর্দান্ত এক মডেল ছিলেন। তাই সর্বকালের সেরা অধিনায়ক বাছাই করতে গেলে আপনি ইমরান খানের নামটাকে কলমের এক খোঁচায় কেটে ফেলতে পারবেন না।

কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ইমরান খান? তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বকীয়তা আছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যেতে পারবেন, রাজনীতির বাইশগজে বাইশ বছর পার করার পরও সে কথগুলো খুব তাড়াতাড়ি লিখে ফেলা যাচ্ছে না। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনেই তিনি বসতে যাচ্ছেন।

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই- ইনসাফ পিটিআই আসনের বিচারে সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে তাতে এককভাবে সরকার গঠন এবং একক সিদ্ধান্তে সরকার পরিচালনা করার ক্ষমতা হয়তো ইমরান খান পাচ্ছেন না। ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ইমরান নিজের মত করে সব কিছইু করতে পেরেছেন।

কিন্তু পাকিস্তানে সরকার গঠন করলে ক্যাপ্টেন হিসেবে সব ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকবে তা ভাবার কোন কারণ নেই। সরকারের ক্যাপ্টেন্সি সত্যিই আলাদা। যেখানে অন্যের সিদ্ধান্তকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক মেনে নিতে হয়।

নিজের ইচ্ছা খুব একটা চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ তিনি পাবেন সেটাই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কারণ, দেশটা পাকিস্তান। যে দেশের সত্তর বছরের ইতিহাসে অনেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তবে সেটা কতটা জনগণের ইচ্ছায় অথবা নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে তা নিয়ে বির্তক রয়েছে।

ইমরান খানের দলের নির্বাচনে জয় নিয়েও বির্তক আছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে সেটা বহুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে। পাকিস্তানে নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি জনগণ নাকি সেনাবাহিনী সেটাই এক বড় প্রশ্ন। সেই প্রশ্নটা আরো বড় হয়ে সামনে চলে এসেছে নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা শেষ করার আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইমরানের জয়কে ‘পাকিস্তানের জয়’ হিসেবে দাবি করে টুইট করায়!

জয় খান সাহেবের বা পাকিস্তানের যারই হোক, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী ক্যাপ্টেন, তা নিয়ে তেমন কোন সংশয় নেই। সংশয় এবং সন্দেহ অন্য জায়গায়। অন্য বিষয়ে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যতো সহজ তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কঠিন টিকে থাকা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার বাইশগজে নিজের উইকেট কতক্ষণ তিনি আগলে রাখতে পারবেন সেটাও এক প্রশ্ন।

তবে উত্তরটা সহজ। যতক্ষণ দেশী এবং বিদেশী প্রভুদের সঙ্গে সংঘাতে না জড়াবেন ততোক্ষণ। পাকিস্তানে রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন। আবার সেনাপ্রধানরাও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক কোন চেহারা দিতে পারেননি তারা। হয়তো কেউ দিতে চানওনি।

বন্ধুকের নল, পারিবারিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, কালো টাকা, পেশিশক্তি এরকম অনেক উপাদানের উপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এর মধ্যে ইমরান খান একটা জায়গায় আপাত ব্যতিক্রম। তিনি পারিবারিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে রাজনীতিতে আসেননি। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরণটা একেবারে নিজস্ব ইমেজে।

দলটা গড়েছেন নিজে। শুন্য থেকে শুরু। রাজনীতির ইনিংসটাকেও তিনি ধীরে ধীরে টেনে নিয়েছেন। আজ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য পাকিস্তান জাতীয় সংসদে যে ১৩৭ আসনের ম্যাজিক ফিগার দরকার তার, সেটার খুব কাছাকাছি তিনি।

এই যে শুন্য থেকে সেঞ্চুরি পেরিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব এটা ইমরান খানের। ইমরান খান-ই তাঁর দলের মুখ। তবে ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মুখ না মুখোশ হবেন সেটা সময় বলে দেবে।

খেলার মাঠ ছেড়ে দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, এমপি হওয়ার নজির বিশ্বে অনেক আছে। ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের বিখ্যাত ফুটবলার জর্জ উইয়া ২০০৩ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন। তারপর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এখন তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট।

শ্রীলংকার বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা সে দেশের একাধিকবারের মন্ত্রী। এখন পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। লংকান আরেক বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার সনাৎ জয়াসুরিয়া তাঁর অধিনায়ককে অনুসরণ করে এমপি।

ভারতের অলিম্পিক পদক জয়ী শ্যুটার রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর এখন সে দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী। উদাহরণ, বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু তারপরও ইমরান খানের জয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে এতো আড়োলন কেন? একটাই কারণ, তিনি ইমরান খান। এবং দেশটার নাম পাকিস্তান। যে দেশের সত্তর বছরের ইতিহাস গণতন্ত্র নিয়ে অন্য কথা বলে।

ইমরান খান এবং তাঁর দল সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। জনগণের মতামতের প্রতিফলন হয়েছে। এটাই কী ট্রুথ! এটাই কী সত্য? উত্তরটা সরাসরি দেয়া ঠিক হবে না। উপায়ও নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তা নিয়েও হলিউডের বিখ্যাত কমেডিয়ান স্টিফের কোবলা কমেডির ঢঙে অনেক ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন। এটা শুধু ট্রাম্পকে নিয়ে নয়। তাঁর সেই কমেডি অনেক দেশের অনেকের ক্ষেত্রে সত্য বলে মনে হয়।

স্টিফেন নিজেই একটা শব্দ আবিষ্কার করেছেন। ‘ট্রুথিনেস’। এর অর্থ হচ্ছে; এটা ঠিক সত্য নয়। মানুষ সত্য বলে মনে করে। বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। কিন্তু অবাস্তবও বলা হচ্ছে না। বরং এক ধরনের মিথ্যা যাকে মানুষের কাছে সত্য মনে হয়। ইমরানের জয়। পাকিস্তানের নির্বাচন। এসব কে কেন যেন ‘ট্রুথিনেস’-ই মনে হয়!

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন