ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কে যাবে কে যাবে না তার দায় জনগণের নয়

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০৪:১৫ পিএম, ২৫ জুলাই ২০১৮

নির্বাচনী আমেজে পড়েছে বাংলাদেশ। যদিও এই মুহূর্তে তিনটি বড় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচারণা চলছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে একথা যে কারোরই মনে হতে পারে যে, দেশের মানুষ আসলে এ বছরের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের বিষয়টিকেই মাথায় রেখে এগুচ্ছে।

বিগত গাজীপুর সিটি নির্বাচন এবং তারপর রাজশাহী সিটি নির্বাচন সরেজমিনে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে ব্যক্তিগত ভাবে আমার তেমনটিই মনে হয়েছে। তবে মানুষের দেখায় ফাঁক থাকতে পারে, কিন্তু ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই মনে হয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আসলে মূল আয়োজন তথা জাতীয় নির্বাচনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো। প্রত্যেকেই বেশ উৎফুল্ল এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো নিঃশঙ্ক। কারণ এ যাবৎ অনুষ্ঠিত কোনো সিটি নির্বাচনেই কোনো সহিংসতার খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী আয়োজনে বেশ বিরল।

একদিকে যেমন দেশের বড় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তেমনই অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখনও ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে বলেই বোঝা যাচ্ছে। তবে এই জোটের অংশীদারিত্ব বাড়তেও পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে গিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেছেন। অতি সম্প্রতি দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো একটি জোট গঠন করেছে। বহু কাঙ্খিত এই জোট দেশের রাজনীতির জন্য একটি সুখবর বটে। সেই সত্তরের দশকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি বামপন্থী দলগুলি একত্রিত হয়ে একটি জোট গঠন করতে সক্ষম হতো তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির চেহারা ও চরিত্রই হয়তো ভিন্ন হতো।

হয়তো সামরিক ছাউনিজাত রাজনৈতিক দলগুলি আজকে বাংলাদেশের মানুষের গলার কাঁটা হতো না। কিন্তু দেরিতে হলেও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি মিলে যে জোট গঠন করেছে তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে যদি কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় তাহলে তা দেশের রাজনীতির জন্য নিশ্চিত ভাবেই সুখবর। আর তাদের সঙ্গে যদি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয় তাহলে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিরাশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা জেনেছি যে, বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে হাত মেলাতে শর্তহীন ভাবে সম্মতি দিয়েছেন ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী। ভোটের রাজনীতিতে হয়তো তিনি কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না কিন্তু বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পক্ষটি সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

ইতোমধ্যে প্রকাশিত খবর থেকে এও জানা যায় যে, লন্ডনে পলাতক ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী তারেক রহমানের সঙ্গেও ড. কামাল হোসেনের বৈঠক হয়েছে। যদিও এর সত্য-মিথ্যে জানা যায় না। এদিকে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে এতোদিন যারা দেশীয় রাজনীতিতে একটি তৃতীয় ধারা হওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন যেমন কাদের সিদ্দিকী, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি থেকে নিগৃহীত হয়ে বেরিয়ে আসা ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাবেক বাম ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, জাসদের আ স ম আব্দুর রব- তারা শেষ পর্যন্ত একমত হতে পেরেছেন বলেই মনে হয় যে, বিএনপি’র সঙ্গে একত্রিত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো গতি নেই। যেহেতু এই নির্বাচনটিই হয়তো হতে যাচ্ছে তাদের শেষ নির্বাচন, সেহেতু তারা হয়তো এবার যদি ক্ষমতায় যেতে না পারেন বা নিদেন নির্বাচনে বিজয়লাভ করে সংসদ সদস্য হতে না পারেন তাহলে তাদের আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

ফলে তারা এতোদিন মুখে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দমালা যঁপে গেলেও এখন তারা ঠিকই মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজাকার জামায়াতে ইসলামী এবং একটি অগণতান্ত্রিক পন্থায় সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিতেও আর দ্বিধান্বিত নয়। এই মুহূর্তে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা তার চেয়েও বড় কথা হলো আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হঠানো।

বিএনপি তাদেরকে কতোটা কি ছাড় দেবে সেটা এখনও জানা না গেলেও তারা মোটামুটি দাবি করছেন যে, বিএনপি আসলে এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তাদেরকে সঙ্গে নেওয়া ছাড়া বিএনপি’র আর কোনোই গত্যন্তর নেই। পরিস্থিতি আসলে কতোটা কি নাজুক তার প্রমাণ এখনও না পাওয়া গেলেও একথা স্পষ্ট যে, এই সকল ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র-তস্য ব্যক্তিসর্বস্ব রাজনৈতিক পক্ষগুলি এখন বিএনপি’র পক্ষপূটে আশ্রয় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে তুমুল আগ্রহী হয়ে উঠছে।

কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র অবস্থা কি? জেনারেল জিয়া দেশের সম্পদকে ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করেছিলেন, মূলতঃ আওয়ামী-বিরোধীদের তিনি একত্রিত করতে সক্ষম হন। ক্ষমতা ছিনতাইয়ের পর বাংলাদেশের জন্য আসা বৈদেশিক সাহায্যের (বলাই বাহুল্য যে, ১৯৭৬-৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য এসেছে) বেশিরভাগটাই জিয়াউর রহমান খরচ করেছিলেন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য। সেই রাজনৈতিক দলটি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে এবং তার পত্নী বেগম জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিশেষ অবস্থানও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সক্ষমতায় দুষ্টু গ্রহের মতো আবির্ভাব হয়েছিল জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমান।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দলটি এক মুহূর্তের জন্যও যে দেশের কথা ভাবেনি কেবল নিজেদের উন্নয়নের কথাই ভেবেছে তার প্রমাণ হলো ২০০৮ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি নিজেদের উন্নয়নের সমর্থনে কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। সেই থেকে দলটির বিপর্যয়ের শুরু।

সর্বশেষ আদালতের রায়ে ও দুর্নীতির দায়ে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর বিএনপি নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটির দূরবস্থা এতোটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, মাঝে মাঝে দলটি নিজেদের অবস্থান জানান দিতেও ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা আরো উদগ্র হয়ে ওঠে যখন দলটির গঠনতন্ত্র সংশোধন করে লন্ডনে পলাতক থাকা তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচিত করা হয়। এতে দেশে-বিদেশে সর্বত্রই বিএনপি সম্পর্কে একটি কঠিন নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়, যা অসত্য নয়।

এরকম দুর্বল ও নড়বড়ে অবস্থান নিয়েই অন্ততঃ দৃশ্যমান শক্তিশালী সরকারের সঙ্গে বিএনপি আগামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে দরকষাকষি শুরু করতে চাইছে। নানা ভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে সরকারের কাছে তারা দাবি পেশ করছে। কখনও বলছে বেগম জিয়ার মুক্তি না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না, কিংবা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। কেউ কেউ আবার আগ বাড়িয়ে একথাও বলছেন যে, তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ দিলেই কেবলমাত্র বিএনপি নির্বাচনে যাবে।

কিন্তু এসব কথা কেবল বিএনপি-শিবির থেকেই শোনা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত একটি ‘মুচকি হাসিও’ হাসার খবর মেলেনি। ফলে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য যে সকল শর্তাদি বিএনপি ক্রমাগত দিয়ে চলেছে তা মূলতঃ তাদেরই নিজস্ব বক্তব্য। সরকার সেটি শুনবে কি শুনবে না তা নিয়ে সরকারের অবস্থানটি জানা যায় না। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে কতোটা ছাড় পাবে নির্বাচনে অংশ নিতে কিংবা নির্বাচনে আসলেই বিএনপি যেতে চায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আর বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে ওপরে যারা বিএনপি’কে দুর্বল মনে করে তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনে যাবে বলে রাজনৈতিক মনকলা খেয়ে যাচ্ছেন, তাদের আশা কতোটা পূরণ হবে সেটা নিঃসন্দেহে শতকোটি টাকার প্রশ্ন বটে।

কিন্তু শুরুতেই বলেছি যে, দেশের মানুষ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে আনন্দনাড়ু কুটতে শুরু করেছে। ঢেঁকিতে তাদের পা পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কে কি করবে তা তাদের নিজস্ব হিসেব-নিকেশ বা সমীকরণ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণকে পাত্তা না দেয় তাহলে জনগণের কী দায় পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর হিসেব-নিকেশে নিজেদেরকে জড়াবে? তারা বরং ভোট দিতে পারলেই খুশি। ভোটের আনন্দ আসলে এদেশের মানুষের কাছে এক বিস্ময়কর উদযাপন।

রাজশাহী ২৪ জুলাই, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন