ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কাকে রেখে কাকে বাঁচাবে বিএনপি?

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১২:৫৫ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৮

বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে এতো কঠিন সংকটকাল আর কখনোই পার করেনি। দলটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং রাজপথের রাজনীতির অভিজ্ঞতা-বঞ্চিত একটি দুধে-ভাতে থাকা রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, তাহলে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে দলটি কী করে রাজপথে নেমেছিল?

প্রথমত: বিএনপি ক্ষমতা হারায় এরশাদ-এর কাছে। ফলে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে বিএনপি-সমর্থকদের কাছে সদ্য হারানো ক্ষমতার জন্য রাস্তায় নামাটাই একমাত্র বিকল্প ছিল।

দ্বিতীয়ত: সেই সময়ই বিএনপি’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন বেগম জিয়া। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার তুমুল আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি যদি তখন মাঠে না নামতো তাহলে দলটির পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল হতো।

তৃতীয়ত: এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, বিএনপি গঠনের পর পরই দলটিতে বাংলাদেশের বামপন্থী বিশেষ করে চীনপন্থীদের অনেক নেতাকে স্থান করে দেওয়া হয়েছিল, যারা মাঠের আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি মূলতঃ তাদের মাধ্যমেই আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। কিন্তু সেটাই শুরু, সেটাই শেষ। এরপর আর কখনও বিএনপি’কে ক্ষমতায় যেতে আন্দোলন করতে হয়নি।

বরং বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আন্দোলন দমনেই অভিজ্ঞ। আরো একটি কথা এখানে বলে রাখা উচিত যে, জামায়াতের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার পর থেকে বিএনপি-নেতকর্মীদের মধ্যেও এক ধরনের মারমুখী আক্রমণাত্মক ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়, যে কারণে ২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দলটি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের ওপর বে-রহমের মতো আক্রমণ চালিয়েছে। তাদের আঘাতের ধরন দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে যে, আক্রমণকারীরা আসলে এদেশের কেউ নয়, কোনো দখলদারী বাংলাদেশকে দখল করে আছে।

জামায়াত যেহেতু বাংলাদেশকে মনে করে পাকিস্তানের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অংশ সেহেতু তারা সেটি পুনর্দখল করার জন্য যেভাবে সম্ভব আক্রমণ করতে উদ্যত- এই মনোভাব জামায়াত বিএনপি’র মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল।

বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপি’র এই দখলদারসুলভ আচরণ গ্রহণ করেনি, যে কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি’র আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতাকে গ্রহণতো করেইনি, বরং সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকেও মেনে নিয়েছে। বিএনপি এই সত্য বুঝতে পেরেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। আর সে কারণেই দুর্নীতির দায়ে বেগম জিয়ার কারাদণ্ড লাভের পরও দলটি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং কোনো ধরনের মারমুখী তৎপরতা শুরু করেনি।

একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল যে কোনো রাজনৈতিক দুর্যোগে ধৈর্য্যহারা হবে না, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জনগণ ও দেশকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবে না, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটাই কাম্য। বিএনপি এই সত্য ধারণ করায় দু’টো বড় উপকার হয়েছে: এক. বাংলাদেশে বিএনপি’র রাজনৈতিক শক্তি দৃঢ় হয়েছে এবং দুই.দেশের মানুষও নিরাপত্তাহীন হয়নি ফলে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পেরেছে। মানুষ এতে বিএনপি’র প্রতি অখুশীতো হয়ইনি বরং আস্থাবান হয়েছে, যেকথা আগেই বলেছি।

কিন্তু বিএনপি কি মানুষের এই আস্থাকে কাজে লাগাতে পারছে? এই প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা করতে চাই। বেগম জিয়ার কারাদণ্ড লাভ নিয়ে বিএনপি’র দলীয় অবস্থান যেরকমটি হওয়ার কথা সেরকমটিই হয়েছে। তারা মনে করে যে, সরকার তাকে অন্যায্যভাবে কারাদণ্ড দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইছে।

দলটি বেগম জিয়ার মামলার শুরু থেকেই আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আসছে। বহুবার আদালত পরিবর্তন করাও হয়েছে, বিচারক বদলানো হয়েছে কিন্তু তারপরও দলটির পক্ষ থেকে আদালতের প্রতি এই অনাস্থা সরেনি। হতে পারে এর জন্য সরকারী দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য ও আচরণও কিছুটা দায়ী। কিন্তু এখনও বিএনপি’র পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো পদক্ষেপ।

অপরদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ভাবে অর্থাৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে মুক্ত করার যে ঘোষণা বার বার দেওয়া হয় তা নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা কতোটা নিশ্চিত সে বিষয়ে বিএনপি-পন্থী বুদ্ধিজীবীদেরই বার বার সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায়। কেউ কেউ প্রকাশ্যে একথাও বলেন যে, বিএনপি’র পক্ষে সেরকম বড় কোনো গণ-আন্দোলন জমিয়ে তোলার সামর্থ নেই, ফলে যা করার আইনী প্রক্রিয়াতেই করতে হবে এবং আইনী প্রক্রিয়া যে ত্রুটিযুক্ত সেটা প্রমাণ করাই হবে বিএনপি’র মূল লক্ষ্য।

একথা বলার কারণ নিশ্চয়ই আছে। সাদা চোখে এটাই মনে হয় যে, বিএনপি রাজপথে আন্দোলনের দল নয়, এমনকি রাজনৈতিক ইস্যুকে সামাল দেওয়ার যোগ্যতাও দলটির আছে কিনা তা নিয়েও তারা সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। যতোবারই দলটি ক্ষমতায় গিয়েছে ততোবারই বহুবিধ কৌশল ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথা শোনা গেছে।

বিশেষ করে ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার কিংবা সেনাবাহিনী বা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার ইত্যাকার অভিযোগ রয়েছে দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার নেপথ্যে। এমনকি ক্ষমতায় গিয়েও তারা প্রমাণ দিয়েছে যে, এসব অভিযোগ একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো ছিল না। ফলে, এখন যখন বিএনপি নেত্রী দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড ভোগ করছেন এবং আরো অনেকগুলো মামলায় তার কারাভোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তখন দলটির ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও অপটুতা দলটির সমর্থকদের হতাশ করে তুলছে।

এতোদিন অজুহাত ছিল সরকার বিএনপি’কে কোনো সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয় না। কিন্তু অনুমতি পেয়েও বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে মহানগর নাট্যমঞ্চে যে প্রতীকী অনশনের চিত্র বিএনপি নেতৃবৃন্দ জাতিকে দেখালো তাতে কট্টর বিএনপি সমর্থকদেরও বলতে শোনা গেছে যে, কোন্ ভরসায় এই ভাঙাচোরা দলটির প্রতি সমর্থন ধরে রাখবো? ভবিষ্যৎ কি? কী ভাবে এই সংকট থেকে দলটিকে মুক্ত করা যাবে? মুক্ত করা গেলেও নির্বাচনে যাবে কিনা? নির্বাচনে গেলেও সেটা কী ভাবে? জনগণকে কী বলে ভোট চাইবে দলটি? শুধুমাত্র সরকারের বিরুদ্ধে বললেই কি মানুষ ভোট দেবে?

প্রশ্ন হাজার, কিন্তু উত্তর দেওয়ার কেউ নেই বিএনপি’তে। গতকাল এই প্রতীকী অনশন শেষে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে যে, বেগম জিয়াকে মুক্তি না দিলে দলটি কোনো ভাবেই নির্বাচনে যাবে না।

নির্বাচনের বাকি আছে আর ছয় মাস। এর মধ্যে কী কী করতে হবে সরকারকে? বিএনপি’র পক্ষ থেকে দেওয়া তার তালিকাটি যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাই যে: এক. বেগম জিয়ার মুক্তি, দুই. তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার, তিন. বিএনপি-নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার, চার. সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, পাঁচ. নির্বাচন কমিশনকে বদল করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ইত্যাদি ইত্যাদি।

তালিকা আরো দীর্ঘ, এগুলো মূলতঃ প্রাথমিক দাবি। এই ছয় মাসে বিএনপি’র আন্দোলন-সংগ্রামে এতোগুলো দাবি আদায় কতোটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন না তুলে বরং আমরা বিএনপি-নেতৃবৃন্দের টক’শো বক্তব্য থেকে এসবের উত্তর খুঁজতে পারি। নেতাদের নামোল্লেখ করতে চাই না, কারণ তাতে তারা আহত বোধ করতে পারেন। কিন্তু প্রত্যেকেই প্রায় একই কথা বলেন, তারা মনে করছেন যে, কিছু একটা ঘটবে, নির্বাচনের আগে এমন কিছু একটা ঘটবে যে, তাতে সরকারের সাজানো ছক উল্টে যাবে এবং বিএনপি’কেই জনগণ ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।

বাংলাদেশে এমন ঘটনা কোনোদিন ঘটেছিল কিনা জানি না। আওয়ামী লীগ রাস্তার আন্দোলনে সক্ষমতা দেখানোর পর, জনগণের কাছে আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণের পরও তাদের হাতে কেউ ক্ষমতা তুলে দেয়নি, নির্বাচনের মাধ্যমেই দলটিকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়েছিল।

বিএনপি-নেতাদের কথা থেকে মনে হয়, তারা মনে করছেন, কিছু একটা ঘটে গেলেই তারা ক্ষমতায় বসবেন। এই কিছু একটা কী, সে প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে যে নেই, সেটা সঞ্চালক যখন পাল্টা প্রশ্ন করেন তখনই তাদের গড়িমসি থেকে স্পষ্ট হয়। এর ফলে তাদের সমর্থকরা আরো হতাশ হন, এবং সেটাই স্বাভাবিক।

সরকার একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। জনগণের কাছে অপ্রিয় হওয়ার কাজটি প্রতিনিয়ত করছে। কিন্তু তাতে বিএনপি’র পক্ষে সাধারণ মানুষ যাচ্ছে সে প্রমাণও কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ, জনগণ, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির কোনো স্পষ্ট রূপরেখা বিএনপি’র কাছ থেকে এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।

মানুষ অন্ধকারে ঝাঁপ দেবে সেরকম দূরবস্থা দেশে এখনও তৈরি হয়নি। বিদেশিরা বেগম জিয়ার মুক্তি চায়, সে প্রমাণও পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত। ভারতে গিয়ে দেনদরবার করে কিছু লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না, বেগম জিয়ার বিদেশি আইনজীবী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োজিত লবিস্ট ব্রিটিশ লর্ড কারলাইল ভারতে আসতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির দূরবস্থা নিয়ে কথা বলার জন্য, তার সংবাদ-সম্মেলনটি বাতিল করা হয়েছে।

কোটা আন্দোলন নিয়ে বিএনপি’র কোনো পরিকল্পনা থেকে থাকলেও তা এখন বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায়, বিএনপি’র সামনে অনেকগুলো ‘অপশন’ খোলা আছে বলে মনে হয় না, কিছু একটা ঘটবে বলে আশাবাদী হওয়া ছাড়া। কিন্তু রাজনৈতিক দূরবস্থা বেশিদিন থাকে না, রাজনৈতিক দলই সেটা থেকে মুক্ত হতে কৌশল গ্রহণ করে। বিএনপি নিশ্চিত ভাবেই একটি পরিপক্ক রাজনৈতিক শক্তি। তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি বোঝে, কিন্তু বিদেশে থাকা দলটির পলাতক-নেতৃত্ব নিজেকে বাঁচাবেন নাকি তার মা বেগম জিয়াকে রক্ষা করবেন নাকি দেশ বাঁচাবেন না মানুষ বাঁচাবেন?

কাকে রেখে কাকে বিএনপি বাঁচাবে এবং কী ভাবে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দলটির সামনে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছুই নেই- এটা বিএনপি’র জনকেরই বহুল ব্যবহৃত উক্তি, নিশ্চয়ই বিএনপি’র বর্তমান নেতৃত্বও সেটি মানেন; দেখাই যাক, কী করে বিএনপি এরপর।

ঢাকা ১০ জুলাই, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন