ইস্যু চাই, না জয়?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তবে এর আগে পরের সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই ভালো। আর বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, এটি একটি নির্বাচনমুখী দল। রাজনীতির মাঠে তাদের টিকে থাকার সবচেয়ে ভালো সুযোগ হলো নির্বাচনের মাঠে থাকা। অন্য কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও নির্বাচনের মাঠে তারা সক্রিয় থাকতে পারে। তাই প্রার্থী হারুক বা জিতুক, যে এলাকায় নির্বাচন হয়, সে এলাকার নেতাকর্মীরা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হওয়ার, জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিএনপির জন্য দারুণ এক সুযোগ।
জিতলে তো ডাবল লাভ। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তো পাওয়া গেলই, সাথে সরকারের জনপ্রিয়তা নেই, এটা বলারও সুবর্ণ সুযোগ থাকছে। আর হেরে গেলেও খুব একটা ক্ষতি নেই। নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা তো গেলই, সাথে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এই অভিযোগ করারও অবাধ সুযোগ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতেছে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। আবার খুলনায় বিএনপি হেরেছে বিপুল ভোটে।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি করপোরেশনে বিএনপি প্রার্থীরা জিতেছিল। মাঠের অবস্থা এতটা ভালো থাকার পরও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। সে নির্বাচনে গেলে বিএনপি জিততেও পারতো, নাও পারতো। তবে না জিতলেও তারা সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু সে নির্বাচন বয়কট করার ফলে বিএনপি না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে আছে।
তারা সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই। খুলনা এবং সর্বশেষ গাজীপুরে ফলাফল উল্টে গেছে। শুধু উল্টে গেছে বললে ভুল হবে। খুলনায় বিএনপি হেরেছে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে আর গাজীপুরে হেরেছে দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে। ফলাফল যতটা না চমকে দেয়ার মত ব্যবধানটা তারচেয়ে বেশি। তার মানে না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে থাকাটা বিএনপিকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেক।
এই সময়ে তারা জনগণের কাছে যাওয়ার মতও তেমন কিছু করতে পারেনি। তাই আগে যে সিটিতে তারা জিতেছিল, এখন সেখানে পাত্তাই পাচ্ছে না। তবে দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, খুলনা এবং গাজীপুরে বিএনপি জিততেই চায়নি। দুই সিটিতেই আগের মেয়রকে আর মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তাদের আসল লক্ষ্যই যেন অভিযোগ করা আর ইস্যু তৈরি।
খুলনা এবং গাজীপুর নির্বাচন তুলসি পাতায় ধোয়া হয়েছে, এমন দাবি কেউ করছে না। কারচুপি, জাল ভোট, এজেন্টদের বের করে দেয়া ইত্যাদি নানা অভিযোগ এসেছে। নিছক অভিযোগ নয়, এর অনেকগুলো সত্যি। যেসব কেন্দ্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেসব কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগে খুলনায় ৩টি এবং গাজীপুরে ৯টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিবেচনা করলে খুলনায় ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩টি এবং গাজীপুরে ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি কেন্দ্রের অনিয়ম খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। জিয়া আর এরশাদ আমলের হোন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডার বিবেচনায় তো এই নির্বাচন অনেক ভালো। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের মানদণ্ডেও মন্দ বলা যাবে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমনিতেই অনেক জটিল। মেয়র প্রার্থী তো থাকেনই, থাকেন কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিল প্রার্থীরাও। ফলে নানামুখী স্বার্থের জটিলতায় নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়। কাউন্সিলর প্রার্থীদের সৃষ্ট অনিয়মের দায় বহন করতে হয় মেয়র প্রার্থীদেরও। শেষ পর্যন্ত কলঙ্কিত হয় নির্বাচন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংঘর্ষ, রক্তক্ষয়, প্রাণহানী অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে যেন। কিন্তু স্বস্তির ব্যাপার হলো অনেক অভিযোগ থাকলেও খুলনা এবং গাজীপুর নির্বাচনে সহিংসতা ঘটেনি।
অনেকে অভিযোগ করছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে কারচুপিও ডিজিটাল হয়ে গেছে। কিন্তু বিএনপির আনা কারচুপির সব অভিযোগ আমলে নিলে, স্থগিত কেন্দ্রগুলোর সব ভোট বিএনপির বাক্সে দিলেও কি ব্যবধানের বিশাল পাহাড় ডিঙাতে পারতো বিএনপি?
খুলনা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। টাটকা গাজীপুরের দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। যথারীতি সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া। কোনো কোনো পত্রিকায় দেখেছি, নির্বাচনের আগের রাতে বা নির্বাচনের সকালে বিএনপি এজেন্টদের কাউকে কাউকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে গেছে। দিনভর পুলিশ লাইনে আটকে রেখে নির্বাচনের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবু আমি ধরে নিচ্ছি, পুলিশ অসত্য বলছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এমন ৪২ জনকে দিনভর আটকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৪২৫টি কেন্দ্রে মোট ১৭০০ ভোট কক্ষ ছিল। তার মানে বিএনপিকে ১৭০০ এজেন্ট নিয়োগ দিতে হতো। কিন্তু বিএনপি প্রার্থী কি ১৭০০ এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিলেন?
এখন এজেন্ট নিয়োগ না দিয়েই যদি এজেন্ট বের করে দেয়ার বা কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ করেন; তাহলে বিশ্বাস করার জন্মে যে জয় নয়, অভিযোগটাই মুখ্য। গাজীপুরের নির্বাচন দেখে আমার মনে হয়েছে, বিএনপি আসলে জিততে চায়নি, অভিযোগ করতে চেয়েছে, ইস্যু বানাতে চেয়েছে। বিএনপির পরাজয়ের প্রথম ধাপ তাদের প্রার্থী মনোনয়ন।
গাজীপুরে আগের নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নানকে না দিয়ে এবার মনোনয়ন দেয়া হয় হাসানউদ্দিন সরকারকে। কেন? অনেকে বলছেন, এম এ মান্নান অসুস্থ। কিন্তু অসুস্থ মান্নানের বদলে যাকে মনোনয়ন দেয়া হলো, তিনি তো আরো অসুস্থ। হাসানউদ্দিন সরকার কারো সহায়তা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। তিনি ভোট দিতে গেছেন, দুজনের কাঁধে ভর করে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাঙ্গীর আলম তরুণ, প্রাণবন্ত। এখন গাজীপুরের মানুষ নিজেদের এলাকার উন্নয়নের জন্য দেখেশুনে কাকে ভোট দেবে?
বিএনপির এই বিশাল পরাজয়ের জন্য তাদের দলের অন্তর্দ্বন্দ্বও দায়ী। এম এ মান্নান অভিমানে নির্বাচনের মাঠেই নামেননি। গাজীপুরের মানুষ দেখেছে, গত নির্বাচনে তাদের ভোটে নির্বাচিত মেয়র কারাগারে কাটিয়েছেন অনেকটা সময়। এবার ভোটি দেয়ার সময় নিশ্চয়ই সেটিও বিবেচনায় ছিল। আর গত ৫ বছরে বিএনপি বা বিএনপির মেয়র এমন কিছু করতে পারেননি, যাতে তাদের জনগণ আবার ভোট দেবে।
পাশাপাশি জাহাঙ্গীর আলম গত ১০ বছর ধরে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছেন। তবে বিএনপির মত গাজীপুরে আওয়ামী লীগেও অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমউল্লাহ খান শুরুতে অভিমান করে থাকলেও পরে অন্তর্দ্বন্দ্ব ভুলে নিজেও জাহাঙ্গীরের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তাই সরকারের ন্যায্য-অন্যায্য নানান কৌশলের পরও গাজীপুরে আওয়ামী লীগের জয় খুব অস্বাভাবিক ঠেকছে না।
তবে আমি একটু উল্টো করে ভাবতে চাই। ফলাফল দেখার পর আমার মনে হয়েছে, যেটুকু অনিয়ম হয়েছে, তা না হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিততো। হয়তো ব্যবধান কম হতো। খুলনা নির্বাচনের টুকটাক অনিয়মের পর গাজীপুরে সরকার খুব সতর্ক ছিল। এত সতর্কতার পরও যারা জাল ভোট দিতে গেল বা অনিয়ম করলো; তারা অবশ্যই সরকারের শুভাকাঙ্খী নয়।
৪২৫ কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি কেন্দ্র বন্ধ হওয়া বড় কোনো ঘটনা নয়। সরকার এই অনিয়মটুকু স্বীকার করে, আমলে নিয়ে যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা নির্বাচনে অনিয়ম করেছে, তারা অবশ্যই সরকারের বন্ধু নয়। জয় নিশ্চিত, এটা জেনেও যারা অনিয়ম করেছে, তারা সরকারকে বিব্রত করতেই চেয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে নাশকতার ষড়যন্ত্রের কথা সবাই জানেন। নাশকতার ছক কাটা বিএনপি নেতা মেজর (অব.) মিজানের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। সেখানে তিনি বিএনপি কর্মীদের নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যারা নির্বাচনে অনিয়ম করেছে, তারা তেমন কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার বদল হয় না, এই যুক্তিতে বিএনপি সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়। এটা তো সরকারও জানে। তারা সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারে। খুলনা এবং গাজীপুরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার রাজশাহী, বরিশাল এবং সিলেটে পরিচ্ছন্ন নির্বাচন করে দেখিয়ে দিতে পারে। নিজেদের জনপ্রিয়তাও যাচাই করে নিতে পারে।
৩০ জুন, ২০১৮
এইচআর/পিআর