ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সড়ক যখন মৃত্যুফাঁদ

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ২৮ জুন ২০১৮

গোটা বিশ্বজুড়ে এখন চলছে ফুটবল ফিভার। বিশেষ করে আমাদের দেশে ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই অন্যরকম এক আমেজের মৌসুম। তার মধ্যে এবার মধুমাসের সাথে লেগেছে এই উত্তেজনার ঢেউ। ঈদের আনন্দও এবার যেন কিছুটা তার জৌলুস হারিয়েছে ফুটবলের এই সবচেয়ে বড় আয়োজনে।

চারদিকে এখন কেবল ফুটবল নিয়ে আলোচনা। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা দলের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা যেন সেসব দলের খেলোয়াড়দের চেয়েও বেশি। আছে প্রিয় দলের সফলতা ও বিফলতায় হাসি কান্নার ঢল।

ঈদের আনন্দ শেষ। প্রতিবার ঈদের ঢাকা ছাড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে উপভোগ করতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলে দেশের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্তে। ছুটি শেষ। আবার জীবনের তাগিদে, জীবিকার তাগিদে মানুষ ফিরতে শুরু করেছে এই ইট পাথরের শহরে।

প্রাণহীন এই শহরে এমন অনেকেই আছেন যারা কেবল জীবিকার প্রয়োজনেই পড়ে আছেন। সুযোগ থাকলে হয়তো নিজ শহর ছেড়ে কেউ এই জঞ্জালের ঢাকা শহরে আসতো না।

দলে দলে মানুষ আবার ফিরছে। বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে, বিমানে। যে যার সামর্থ অনুযায়ী পরিবহনের মাধ্যম বেছে নেয়। কিন্তু একটি পরিসংখ্যান যেন কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। একদিনে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩৫ জন। আহতের সংখ্যাও কম নয়। গাইবান্ধাতেই একটি বাস খাদে পড়ে দিয়ে নিহতের সংখ্যা ১৮।

এমন ঘটনা আছে সারা দেশেই। আমাদের দেশে এখন মৃত্যু কোন ঘটনাই নয়। কেবল কিছু সংখ্যাতেই এর পরিচয় নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি এখন আর কেউ দিতে পারছে না। প্রতিদিন কতভাবেই না মরছে মানুষ। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কিন্তু মানুষের জীবনের মূল্য কমছে উধ্র্বগতিতে। প্রতিবছর ঈদ মানেই কিছু মানুষের মৃত্যুর হিসাব।

নদীপথে যাতায়াত করে দেশের লাখো মানুষ। নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই সেইসব যাত্রীদের। অতিরিক্ত যাত্রী বহন, পুরনো লঞ্চকে নতুন করে যাতায়াতের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে মালিকরা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের লঞ্চ দুর্ঘটনার কথা নিশ্চয়ই আমরা কেউ ভুলে যাইনি। সিনেমার দৃশ্যের মত লঞ্চের পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়ার একটি ভিডিও আমাদের সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছিলো। যথারীতি তদন্ত কমিটিও হয়েছিলো।

সারাদেশ উত্তাল হয়েছিলো প্রতিবাদে। একসাথে এতগুলো মানুষের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারিনি আমরা কেউই। উদ্ধার করতে পারেনি সকল মৃতদেহ। অবশেষে উদ্ধারকার্যকে স্থগিত করেছিলো কর্তৃপক্ষ। এভাবেই দিনের পর দিন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। এখন আর আমরা খবরও রাখি না কোথায় কে কেমন করে মরে যাচ্ছে।

এই লেখাটি লিখতে লিখতেই ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জসহ দেশের আরও কয়েকটি স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেলো। এভাবেই বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই প্রিয়জনের কাছে যাওয়া। কিন্তু দিনে দিনে এই ঈদ যেন হয়ে উঠছে মানুষের জীবন হারানোর মৌসুম।

সারাবছরে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও ঈদের সময়টাতে এ যেন মহামারী হয়ে পড়ে। প্রতি ঈদের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছ থেকে দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনামূলক খবর পাওয়া যায়। সড়কে নিরাপত্তার ফিরিস্তি শুনা যায়। মানুষের নিরাপদে বাড়ি যাওয়া ও ফেরা নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দিয়ে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু হায়! সবই যেন কথার কথা হয়েই ফিরে যায় বারেবারে।

কারও কোন মাথাব্যথা নেই যেন। লোক মরছেতো কী হয়েছে? ভাবখানা এমন যেন ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে শ' খানেক লোকের মৃত্যুতে কী বা আসে যায়? ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভ্রুক্ষেপ নেই কারোই। লাইসেন্সবিহীন গাড়ী চলাচলে নেই কোন মনিটরিং সেল।

লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি দিব্বি কালো হাওয়া ছেড়ে দিয়ে ছুটে চলে মহাসড়কে। ঈদ এলেই যেন সবাই ফ্রি লাইসেন্স পেয়ে যায় মহাসড়কে চলার। ছোট ছোট পিক আপ ভ্যানগুলোকেও দেখা যায় ঝুলন্ত যাত্রী নিয়ে ছুটছে এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এ এক আজব রাজত্ব যেন।

তবে আশার কথা হচ্ছে যার উপর সব দায়িত্ব সেই প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হলো। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই এক সমস্যাকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না আমাদের বাকপটু ক্যারিশমেটিক সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী।

শত শত মানুষের মৃত্যু ঠিকই উদ্বেলিত করেছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। বিপুল জনসংখ্যার এই এতটুকু একটি দেশে এমনিতেই সমস্যার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। দেশ এক কিন্তু সমস্যা হাজার। মানুষ অনেক কিন্তু দেখার লোক কেবল একজন। এই একজন নির্ভর দেশের ভবিষ্যৎ কেমন সেটি কী একবার আমরা সবাই ভেবে দেখেছি?

আবারো সেই উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সড়কে মৃত্যু ঠেকাতে। নিয়মের প্রয়োজনীয়তার ঘোষণা দিলেন। মন্ত্রীর মুখে গর্বের হাসি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। সুতরাং এইবার কিছু হবেই। তাহলে একজন মন্ত্রী কী এতটাই অসহায় যে তিনি নিজে কোন আইন বা নিয়মের প্রস্তাব করতে পারেন না?

যাই হোক, বাস্তবতা এটাই যে আমাদের এটাই নিয়তি হয়ে যাচ্ছে যে মানুষের জীবনের মূল্য এখানে পানির চেয়েও কমে যাচ্ছে। পানিও এই দেশে বিনামূল্যে পাওয়া যায় না কিন্তু বিনামূল্যে মানুষের জীবন নিয়ে নেয়া যায়। কোন বিচার হবে এই নিশ্চয়তা কেউ দেবার নাই।

বিচারহীনতার হাজারো উদাহরণের মাঝে এটিও একটি। সড়কে এভাবে মানুষ মারা যাওয়া কোন স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। এটি মৃত্যু নয়, হত্যা। আর যেকোন হত্যাকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সেটির বিচার নিশ্চিত করা সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে কেবল গাড়ি চালানোর ক্ষমতা অর্জনেই কেউ আরেকজন মানুষের জীবন নিয়ে নেবার লাইসেন্স পেয়ে যায় না। তাহলে সে দেশকে আর সভ্য দেশ বলা যায় না। আমরা চাই এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কঠোর ব্যবস্থা নিবে, গড়ে উঠবে সামাজিক আন্দোলন। নিশ্চিত হবে মানুষের চলাচলের অধিকার।

জীবনের নিশ্চয়তা দিবে রাষ্ট্র। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাবে প্রতিটি মানুষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ব্যক্তিরা কেবল প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে না তাকিয়ে নিজেরাও কিছু করে দেখাবে দেশ ও জনগণের জন্য, এমনটাই আশা করি।

লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন