ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মেসি-মুসায় হুজুগ : দেশি ফুটবলে দুর্যোগ

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ২৭ জুন ২০১৮

অমুক যদি তমুকের সাথে ড্র করে। তমুক যদি আউট হয়ে যায়। অমুক উৎরে উঠলে। তবে, কিন্তু তমুকের একটা চান্স এসে যেতে পারে। গত ক’দিন এই কিছিমের যদি, কিন্তু, তবে মেশানো স্পোর্টস নিউজেরই একচেটিয়া বাজার।

মানুষের এখন যত মোহ ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, সেসি-মুসাদের দিকে। এই ফাঁকে বন্দুক-মাদক, গীবৎ, ধরপাকড় সমানেই চলছে। প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় কতো প্রাণ ঝরছে, ঘুষ-দুর্নীতি কোন মাত্রায় চলে যাচ্ছে- এ সংক্রান্ত খবরের দেখা কম। বাজারও মন্দা। এ নিয়ে মাতবোল নেই বললেই চলে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস, অসুখ-বিসুখ, মুক্তি আটকে থাকা, রেলে কাটা পড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুমন জাহিদের রহস্যজনক মৃত্যু, মুন্সিগঞ্জে মুক্তমানা শাহজাহান বাচ্চু খুন, এমপি পুত্রদের বিলাসি খুন-খারাবির খবরাখবর মাঠে মারা গেছে।

কক্সবাজারে একরাম হত্যার অডিও তো এখন বাসী হয়ে গেছে। খবর চালানদারদের কাছে এগুলোর তেমন নিউজ ভ্যালু নেই। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসবের চেয়ে ফুটবলের গালগল্প মজাদার। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে ঝগড়া, এদের পতাকায় দেশ ছেয়ে ফেলা, জমি বেচে বিশাল পতাকা বানিয়ে তাদের প্রশস্তি গাওয়ায় পরম সুখ।

দেশীয় ইস্যুর পর ইস্যুগুলো এখন নন ইস্যু। এক ঘটনার আগে-পরে আরেক ঘটনা, কথার পিঠে কথায় জঘন্য অনেক ইস্যু গায়েব বা তামাদি করে দেওয়া যাচ্ছে কথার বাহাদুরিতে। তনু, মিতু, এসপি বাবুল আকতারসহ কত ইস্যু তলানিতে চলে গেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনা ৪৮ ঘণ্টার ঘুরপাকে মোটামুটি শেষ। ইউএনও সালমনের হাজত খাটার ঝামেলাও এখন মাটিচাপায়।

ভারতে নিয়ে চিকিৎসার জেরে শাহবাগে কলেজছাত্র সিদ্দিকের দুই চোখ নষ্টের ইস্যুও তামাদির পথে। লুঙ্গি আর অর্চনার কচলানিতে ফরহাদ মজহার ইস্যু আরও আগেই খতম। ধর্ষণ-গণধর্ষণ ধামাচাপা বা পাশ কাটাতে হচ্ছে না।

নিজে না খেললেও বাংলাদেশের সর্বত্র বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যারপরনাই মাতামাতি। ঝোঁক বা ফ্যাশনের মতো এ মাতামাতিতে কে নেই? ছাত্র-ছাত্রী, রিকশাচালক, চা দোকানদার, সবজি বিক্রেতা। কর্মহীন-গৃহহীনও বাদ নেই। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকলেও দেশ দুটির জন্য তাদের আগ্রহ-ভালোবাসা অফুরান।

পারলে জান দিয়ে দেয়ার অবস্থা। অথচ আফসোস নিজ দেশের ফুটবল সম্পর্কে তাঁদের গরজ নেই। কারো কারো হয়তো ধারণাও ঠনঠনে। দেশের পাঁচটি ফুটবল ক্লাব বা ফুটবলারের নাম জানা নেই। সালাহউদ্দিন, পিন্টু, চুন্নু বা সালাম মুর্শেদির বেশি তেমন কারো নাম জানে না। ফুটবল নিয়ে এই উন্মাদনার দেশের ফুটবলের কী দশা!

আবাহনী-মোহামেডানের বাইরে ব্রাদার্স, রহমতগঞ্জ বা ওয়ারীর মতো দলগুলোর নাম ভুলেই গেছে। স্টেডিয়ামে দর্শক গ্যালারি ফাঁকাই পড়ে থাকে। জাতীয় দলের ফুটবলারদের নাম জানে না মানুষ ঠিকমতো। আগে নানা পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্ট হলেও এখন সেগুলো হয় না।

অনেকের দেশের মাটিতে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখার স্মৃতিও নেই। অতি ক্ষুদ্র দেশ পানামাও বিশ্বকাপ ফুটবলে জায়গা করে নিয়েছে। যে দেশের জনসংখ্যা আমাদের কুমিল্লা শহরের বেশি হবে না। নিজ দেশের গ্যালারিগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে। কেন, কার পাপে বা দোষে এ দশা- এ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। কেমন করে, কীভাবে হলো এত বড় একটা অধঃপতন? এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই ফুটবল ঘরানার মধ্যেই।

ফুটবলের ধারাবাহিক দুর্দশা শুরু প্রায় দেড় যুগ ধরে। এর মাঝে প্রায় ১০ বছর আগে কাজী সালাউদ্দিন ফুটবল ফেডারেশন প্রধানের দায়িত্ব পেলে ফুটবল নিয়ে নতুন আশাবাদের সূচনা ঘটে। শেষমেষ আশা মেটেনি। আন্তর্জাতিক অবস্থানে প্রায় ৫০ ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের।

২০০৯ সালে ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৭। এখন ১৯৪, একবার তা নেমেছিল ১৯৭-এ। ফুটবলপাগল ১৬ কোটি লোকের এ দেশের ওপর আছে এখন ২৬ কিলোমিটার আয়তনের ম্যাকাও, ৩৮ হাজার লোকের দেশ লিখটেনস্টাইন আর হতদরিদ্র দক্ষিণ সুদানের মতো দেশ। যে ভারতকে আমরা দু-একবার হলেও ছাড়িয়ে যেতাম র‌্যাংকিংয়ে, এখন তাদের চেয়ে আমাদের অবস্থান প্রায় ১০০ ধাপ নিচে।

গত চার বছরে প্রতিবেশি দেশ ভারত ৮০ ধাপ এগিয়েছে ফিফা র‌্যাংকিংয়ে । আর আমরা এই সময়ে উল্টো পিছিয়েছি প্রায় ৩০ ধাপ। কেন, এমন দুর্যোগে বাংলাদেশে ফুটবল? ফেডারেশন বা ফুটবল আয়োজক-সংগঠকদের এ নিয়ে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি?

গত ক’দিন দেশের টেলিভিশন এবং দৈনিক পত্রিকাগুলোয় বিশ্বকাপময়। কোন দল বা কোন প্লেয়ার কোথায় কি ভুল করলো তা নিয়ে চুল-চেরা বিশ্লেষণের ধুম। আলোচক বা লেখক থাকেন আমাদের ফুটবল তারকারা। কারো কারো ভাবনমুনায় মনে হয়, তারা এক সময় পেলে, ম্যারাডোনা, নেইমার, মেসি, মুসাদের কোচিং করিয়েছেন।

পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, দু’বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার কোন পজিশনের কী দুর্বলতা? তা কিভাবে কাটানো যায় সেই উপায়ও বাতলে দিচ্ছেন। কিন্তু এই সবজান্তারাও দেশীয় ফুটবল নিয়ে কিছু বলছেন না। বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনার চান্সে ইচ্ছা করলে তারা আমাদের ফুটবলের মানোন্নয়ন নিয়ে দু’চারটা কথা বলতে পারেন। নেপালের সাথেও তারা কেন ধোলাই খান- তার মূল্যায়ণ করতে পারেন। কিন্তু কেউ তো ভুলেও সেই পথে যাচ্ছেন না।

ফুটবলে বাংলাদেশ কখনো বড় শক্তি না হলেও এক সময় দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের সালাউদ্দিন, মুন্না, কায়সার হামিদ, চুন্নু, নান্নু, বাদল রায়দের গুনতে হতো। তারা কম উন্মাদনার জন্ম দেননি। তারা শুধু পা বা মাথা দিয়ে খেলেননি; হৃদয় দিয়েও খেলেছেন। খেলেন যন্ত্র-মন্তের মতো। সেই আমরা এখন মানের দিক দিয়েও ফুটবলে বিশ্বের মধ্যে নিম্নমানে। তাদের বহু আগে,ফুটবলার সামাদকে বাঙালি জাদুকর উপাধি দিয়েছে।

কিংবদন্তিতে সামাদ সর্বকালের সেরা ফুটবলারের চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। সামাদের শট গোল পোস্টের কয়েক ইঞ্চি উপর দিয়ে চলে গেল। গোল পোস্টের মাপ ঠিক নেই, চ্যালেঞ্জ করলেন সামাদ। মেপে দেখা গেল, গোল পোস্ট চার ইঞ্চি নিচু। আরেক খেলায় সামাদের শট গোল পোস্টের পাশ দিয়ে চলে গেল। সামাদ চ্যালেঞ্জ করলেন। মেপে দেখা গেল গোল পোস্ট কয়েক ইঞ্চি ছোট।

সামাদের শটে এত জোর ছিল যে, বল ধরার পর গোলরক্ষক বলসহ গোল পোস্টে ঢুকে যেতেন। জমিদাররা সামাদকে তাদের দলে খেলানোর জন্যে নিয়ে যেতেন। মাঠে নামার সময় সামাদ জমিদারের কাছে জানতে চাইতেন, গোল কয়টি দেব? জমিদার হয়ত বলতেন তিন চারটি। সামাদ বল নিয়ে সারা মাঠে নৈপুণ্য দেখাতেন, গোল করতেন না। জমিদার চিন্তিত হয়ে পড়তেন। খেলা শেষ হওয়ার দশ পনেরো মিনিট আগে সামাদ পটাপট তিন চারটি গোল দিয়ে মাঠ ছাড়তেন।

বাঙালির ফুটবল প্রেমে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ আমেরিকার প্রতিও এ মৌসুমে আমাদের মোহ নেই। অথচ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা ল্যাটিন কোনো দেশে আমরা কাজের জন্যে যেতেও চাই না। এ প্রশ্নে নাম্বার ওয়ান টার্গেট আমেরিকা।

এছাড়াও দেশটিতে বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ আমাদের। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার আমেরিকা। এরপরও ফুটবলে গড়পড়তা সবাই আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা ইউরোপের কোনো দেশের সমর্থক।

পৃথিবীর অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি ইতালি এবার বিশ্বকাপে নেই। তা বাঙালি মনে সামান্যতম কোনো গুরুত্ব পায়নি। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল যদি বাদ পড়তো, বেদনায় নীল হয়ে যেত বাঙালি মন। ম্যারাডোনা-নেইমারদের বাধা দিতে যারা ফাউল করে বাঙালি মন তাদের প্রতি ক্ষিপ্ততা দেখায়। ম্যারাডোনার হাত দিয়ে করা গোলও বাঙালি মনে ফুটবল নান্দনিকতা হিসেবে স্থান পায়।

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিতর্কিত পেনাল্টিতে যখন জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়, ম্যারাডোনার চেয়ে বেশি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাঙালি মন। ম্যারাডোনার মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, ক্যানিজিয়াদের মাদকাসক্ত করে তোলার পরও বাঙালি মন ম্যারাডোনার জন্যে কাঁদে।

পুরো দল যার মাদক নেওয়ার কারণে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়, সেই ম্যারাডোনার কোনো দোষ দেখে না বাঙালি মন। সাংবাদিকদের এয়ারগান দিয়ে গুলি করলেও, বাঙালি মন ম্যারাডোনার প্রতি এতটুকু বিরূপ হয় না। রাশিয়ার ধূমপানমুক্ত স্টেডিয়ামেও, ম্যারাডোনা চুরুট ধরাতে পারেন। সেটা দেখতেও বাঙালির মন্দ লাগে না।

আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো দেশের সঙ্গে আফ্রিকার কোনো দেশের খেলায় বাঙালি মন কাঁদে আফ্রিকার জন্য। এটার কারণ শ্রেণিগত। বাঙালি মন সব সময় নিপীড়িত- নির্যাতিতদের পক্ষে। আফ্রিকান কালোদের প্রতি বাঙালি মনের দরদ দৃশ্যমান হয় প্রতিটি বিশ্বকাপে।

নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, কিছুটা ধর্মীয় কারণে, সমর্থন করে ইরান বা অন্য কোনো মুসলিম দেশকে। দেশপ্রেম, দেশভাবনা সেই হারে থাকলে বা বাড়লে নিশ্চয়ই ভাবনায় আসতো নিজদেশের ফুটবলের কথা।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন