রেলে কালো বিড়ালেরই জয়গান যত প্রকল্প তত লোকসান
অনেক সমালোচনার মধ্যেও ট্রেনেই আগ্রহ বেশি মানুষের। এ বাস্তবতা এবারের ঈদ মৌসুমেও। দুর্ঘটনা, মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, সময় বরবাদ, পথে পথে নৈরাজ্যসহ নানা কারণে সড়ক পথের চেয়ে রেলের প্রতি মানুষের এ ঝোক।
আবার বাংলাদেশ রেলওয়েতে প্রকল্পের কোনো শেষ নেই। কিন্তু লাভের বদলে রেলে শুধু লোকসানের খবর। প্রকল্প মানেই রেল সংশ্লিষ্ট কালো বিড়ালদের মোটাতাজাকরণ। এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ১২ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ সংক্রান্ত একটি ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়।
মানুষের এতো আগ্রহ, টিকিটের সংকট, প্রকল্পের পর প্রকল্প- এরপরও বাংলাদেশে রেল কবে লাভ করবে বা লোকসান কাটবে?- এ বিষয়ক কোনো খবর নেই। রেলের এ লোকসান নিয়ে কিছু তথ্য-গবেষণা থাকলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। কালো বিড়ালদের কাছে তা হাসির আইটেম। বলা হয়ে থাকে, রেলে যত প্রকল্প-তত চুরি, যত আমদানি তত কমিশন। তাই কখনো কখনো কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বেশি মনোযোগ সংশ্লিষ্টদের।
রেলের গুরুদায়িত্বে ধবধবে সাদা ফেরেশতা বসালেও দিন কয়েকে কালো বিড়াল হয়ে যাবে। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কোনোটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। আবার প্রকল্পের ব্যয় বাড়েও। দুর্নীতি ও অনিয়মই এর নেপথ্য কারণ।
নিয়োগ, কেনা-কাটা, টিকেট বিক্রিসহ নানা বিষয়ে দুর্নীতি সেখানে মামুলি ব্যাপার। যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে পৃথক রেলওয়ে মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার। এর পর প্রতিবছর রেল খাতে বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু রেললাইন বেড়েছে সামান্যই। এর পরিণতিতে রেলযাত্রীদের সেবার মানের পরিবর্তে ভোগান্তি ও ভাড়া বেড়েছে। কিছু নতুন বগি সংযুক্ত হওয়ায় গুটিকয়েক ট্রেনে স্বস্তি মিললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেবার মান উল্টো কমেছে।
ট্রেনের সিটে ছারপোকা, ছেঁড়া-ফাটা সিট, রাতে বাতি জ্বলে না, টয়লেটে আলো-পানি নেই, ফ্যানের পাখা ঘোরে না, বন্ধ হয় না জানালা, একবার বন্ধ হলে আর খোলে না, বিনা টিকেটের যাত্রীদের চাপে বসা দায়, হকার-পকেটমারের উৎপাত, ট্রেনে ক্যাটারিংয়ে মানহীন জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যসহ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ে। আর এসব সমস্যা দেখারও যেন কেউ নেই।
রেলে পদে পদে বেড়েছে লুটপাট ও দুর্নীতির অংক। এ উদ্দেশ্যে বাড়ছে লাগামহীন ব্যয়। কখনো কখনো তা হাস্যকরও। এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে কোথাও ব্যয় হচ্ছে ১৪ কোটি, আবার কোথাও ৪৮ কোটি টাকা। ২০১৭ এর ডিসেম্বরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে উপস্থাপিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও নির্মাণ ব্যয়ে বড় তারতম্যের চিত্র উঠে আসে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর রেলপথ নির্মাণ ব্যয়ের তুলনামূলক প্রতিবেদন চেয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের অধীনে একটি সমাপ্ত ও চারটি চলমান প্রকল্পের ব্যয়ের চিত্র উপস্থাপন করে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও চীনের রেলপথ নির্মাণ ব্যয়ের তথ্য মেলেনি।
কমিটির সদস্যরা পরবর্তী বৈঠকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্যসহ প্রতিবেদন দিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালার চর নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৮৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৪৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণ ব্যয় ১৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু খুলনা থেকে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের আরেকটি প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ধরা হয় ৪৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ব্যয়ে এতবড় ব্যবধানে হতবাক হন সংসদীয় কমিটির কয়েক সদস্য।
এক সময় রেলে বিনিয়োগের হাহাকার ছিল। ছিল লোকবলের স্বল্পতা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে রেলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থায়ন বাড়তে থাকে। দেয়া হয় অসংখ্য নিয়োগও। এক পর্যায়ে ঘোষণা হয় আলাদা মন্ত্রণালয়। তখন শোনানো হয়েছিল নানা আশা জাগানিয়া কথা।
বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে রেলের উন্নতি দৃশ্যমান হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে। ২০১৮’র মাঝামাঝিতে এসে কী দেখা যাচ্ছে? ২০২০ সালেও কী হতে পারে- বোঝার তেমন বাকি নেই। রাজনীতির জনমভর সংবিধান, আইন আর নীতিকথা আওড়িয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন দুর্নীতিতে।
একপর্যায়ে হয়ে যান দফতরহীন। পরে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক মন্ত্রী হিসেবে। রেলের বর্তমান মন্ত্রী মুজিবুল হক দায়িত্বগ্রহণের পর সেই দুর্নীতির কালো বিড়াল আরও মোটাতাজা হয়েছে, হচ্ছে। আর এ খাতটিকে ধরেই নেয়া হয়েছে লোকসানের খাত হিসেবে। এতো সুযোগ ও বরাদ্দ রেলের দায়িত্বশীলদের মাথা নষ্টই করেছে। এ জন্যই সাধারণ ইঞ্জিন ও বগির সংকট দূর না করে সবার আগে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছে।
পরে ডেমু একটি অজনপ্রিয় ট্রেনে পরিণত হয়। প্রকল্প নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন ট্রেন চালু, এমনকি কোন স্টেশনে ট্রেন থামবে— সবকিছুই রাজনৈতিক ও ব্যক্তি বিবেচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঠিকাদারের স্বার্থ ও কমিশন-বাণিজ্যই মূখ্য। রেললাইন নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাতে গোনা দু-তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা ভাড়া বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান। গেল বছর রেলের লোকসান ১৮৫৩ কোটি টাকা। রেলে ব্যয় হয় দুই ধরনের।
একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অন্যটি অনুন্নয়ন খাতে। উন্নয়ন বাজেটের অধীনে সমাপ্ত এবং চলমান প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই নতুন রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, ইঞ্জিন-বগি ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ-সংক্রান্ত। অনুন্নয়ন খাতে বেশির ভাগ ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতায়। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সাত বছরে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা।
এসব অর্থ এসেছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরকারের বাজেট থেকে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত। চীন অর্থ ছাড় না করলেও প্রস্তাবিত প্রকল্প ধরলে সবার ওপরে চলে যাচ্ছে চীন।
আর এ সময় ট্রেন পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে রেলে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এই সময় রেল আয় করেছে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো সুদে-আসলে ফেরত দিতে হবে। এক সময় দেখা যাবে রেলের আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তি কোথায় গিয়ে ঠেকে? কালো বিড়ালরা তাই বুঝেশুনেই মোটা-তাগড়া হচ্ছে। হাছিল করছে জয়গানও। শাস্তি বা বিচারের কোনো শঙ্কাই নেই তাদের।
স্বাধীনতার পর রেল পরিচালন মুনাফা দেখাতে পারেনি। বা দেখায়নি। ধরেই নেয়া হয়েছে এ সেক্টরে লাভ দেখাতে নেই। লোকসান দিতেই থাকবে। সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে তাই গরজও নেই। তারচেয়ে প্রকল্প, কেনাকাটা, নিয়োগের মতো কাজে খাইদাইতেই বুদ্ধির পরিচয়। রেল ভ্রমণে দিন দিন যাত্রীদের চাহিদা বাড়লেও তা লাভজনক না করার মূল রহস্য এখানেই।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর