‘নো মিন্স নো’
বাংলাদেশে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটলে মুহুর্তেই আমরা অপরাধীকে আড়াল করে ভিকটিমের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে যাই। ছেলেমানুষ এই বয়সে এমন একটু আধটু করেই; এ কথা বলে ধর্ষকের অপরাধকে হালকা করা হয়। আর সব দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হয় ধর্ষিতার ঘাড়ে।
মেয়েটি কেন সুন্দরী হলো, মেয়েটি কেন ফিরে তাকালো, মেয়েটি কেন হেসে কথা বললো, মেয়েটি কেন চোখে চোখ রাখলো, মেয়েটি কেন জন্মদিনের পার্টিতে গেল, মেয়েটি কেন অমন খোলামেলা পোশাক পরলো, মেয়েটি কেন গাড়িতে উঠলো ইত্যাদি ইত্যাদি। খলের কখনো ছলের অভাব হয় না।
গত ৯ জুন মধ্যরাতে রাজধানীর কলেজ গেট এলাকায় চলন্ত প্রাইভেট কারে ধর্ষণ চেষ্টার সময় যানজটের কারণে জনগণের চোখে ধরা পড়ে যায় ধর্ষক।
মাতাল ধর্ষকের অবশ্য যানজটের খবর মাথায় ছিল না। জনগণ তাকে এবং তার চালককে গণপিটুনি দিয়ে দিগম্বর করে ফেলে। চালক ফারুক পালিয়ে গেলেও ধর্ষক মাহমুদুল হক রনিকে আটক করে পুলিশ। আটক করা হয়েছে প্রাইভেট কারটিও।
নির্যাতিত নারীর দায়ের করা মামলায় ধর্ষক রনিকে তিনদিনের রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধর্ষণের প্রমাণও পেয়েছে। জানা গেছে, রনির গ্রাসের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় থাকে।
উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর এবং পেশায় ব্যবসায়ী। রাফি আহমেদ নামে একজন ফেসবুকে গণপিটুনির দুটি ভিডিওসহ সেই ঘটনা শেয়ার করলে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
পরে জানা যায়, রনি খেজুর বাগান এলাকা থেকে দুটি মেয়েকে জোর করে গাড়িতে তোলে। তাদের একজনকে শ্যামলী শিশু মেলা এলাকায় নামিয়ে দেয়। অপরজনকে সে চলন্ত গাড়িতেই ধর্ষণের চেষ্টা করে। যেটা কলেজ গেট এলাকায় যানজটে আটকা পড়ায় সবার চোখে পড়ে।
সেই ঘটনায় নিন্দার ঝড় যেমন ওঠে, তেমনি কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, মেয়েটি যৌনকর্মী। এখানে দুটি পয়েন্ট; প্রথমত যৌনকর্মী হলেও আপনি চলন্ত গাড়িতে প্রকাশ্যে যৌনকর্ম করতে পারেন কিনা? দ্বিতীয়ত যৌনকর্মী হলেও কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে যৌনকর্ম করা যায় কিনা?
রাফি আহমেদ তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, সামনের গাড়িতে ধস্তাধস্তি দেখেই তিনি কৌতূহলী হয়েছেন। জনগণও ধস্তাধস্তির কারণেই প্রথমে গাড়িটি আটক করে। তার মানে মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রনি তার সাথে যৌনকর্ম করছিল।
যৌনকর্মী হোক বা না হোক, কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌনকর্ম করা অবশ্যই অপরাধ। এমনকি স্ত্রীর অনিচ্ছায় তার সাথে যৌনকর্ম করতে চাওয়াও অপরাধ।
অনেক ধর্ষক নারীদের ‘না’ কে নিজে নিজে ‘হ্যা’ হিসেবে ধরে নেন। কিন্তু এটা একদম পরিস্কার- নো মিনস নো। না মানে না। এখানে অন্তর্যামী হয়ে ধর্ষণকে জায়েজ করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি পেশাদার যৌনকর্মীও যদি প্রথমে সম্মত হয়ে পরে আবার অসম্মতি জানায়, তাও তা মানতে হবে।
মানে দুই পক্ষের সম্মতি ছাড়া যৌনকর্ম অবশ্যই অপরাধ। এটাকে কোনো যুক্তিতেই খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আর বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় চলন্ত গাড়িতে সম্মতি বা অসম্মতি যাই হোক, যৌনকর্ম অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্ষক মাহমুদুল হক রনির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এখন সময়ের দাবি।
এই ঘটনায় আরো কিছু পয়েন্ট আমাদের ভাবায়। আমরা অনেকদিন ধরেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের কথা বলে আসছি। এটি হতে পারে তার একটি উদাহরণ। রাস্তায় কোনো ঝামেলা দেখলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া আমাদের স্বভাব। কিন্তু এখানে উপস্থিত জনতা তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ করায়ই ধর্ষক আটক হয়েছে। তাকে আটক না করলে সেই তরুণীর পরিণতি কী হতো, তা আমরা এখন ভাবতে পারছি না।
অন্তত বিচার যে পেতেন না, তা নিশ্চিত। জনতার তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিটাও আরেকবার প্রমাণিত হলো। রাফি আহমেদের স্ট্যাটাসের সূত্রেই এই ঘটনায় সামাজিক প্রতিরোধ শক্তি পেয়েছে।
তবে এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি নেতিবাচক ও ক্ষতিকর দিকও সামনে চলে এসেছে। মাহমুদুল হক রনির ফেসবুক প্রোফাইল রনি হক নামে। দ্রুত তা চিহ্নিত করে ফেলে লোকজন। দেখা যায় রনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। তার প্রোফাইলে একটি পারিবারিক ছবি আছে। অতি উৎসাহী ফেসবুকাররা ‘এমন সুন্দর বউ আর এমন ফুটফুটে সন্তান থাকার পর মানুষ কিভাবে এমন কাজ করতে পারে’ এই কথা বলে সেই ছবিও ভাইরাল করে ফেলে।
এখানেই গণমাধ্যমের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পার্থক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো সম্পাদক নেই, কোনো এথিক্স নেই। নইলে রনির নিরপরাথ স্ত্রী-সন্তানকে সামাজিকভাবে অপদস্তক করাটাও কিন্তু শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একটা অপরাধ কখনোই আরেকটি অপরাধের যুক্তি হতে পারে না।
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ। এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে হবে, জোরদার করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ধর্ষকের সাজা। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরো সতর্ক ও সংবেদনশীল হতে হবে।
এইচআর/জেআইএম