ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঈদ পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১১:৫০ এএম, ১৩ জুন ২০১৮

 

রহমত, মাগফিরাত, নাজাত হাসিল যা-ই হোক এবার ঈদ পলিটিক্স বেশ জম্পেশ। সঙ্গে অর্থনীতিও। সংযম-আত্মশুদ্ধি, ঈদ এবার বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে বেশ মোক্ষম সময়ের উপলক্ষ। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটাই শেষ রমজান। শেষ ঈদুল ফিতর।

ধর্ম ও সামাজিকতার নামে ভোটারদের বাগে পাওয়ার আখেরি মওকা। এই দিনপঞ্জি বুঝেই গেল রমজান ও ঈদে স্থানীয় নেতাকর্মী ও এলাকার মানুষকে কিছুটা ছ্যাকা দিয়েছিলেন এমপি-মন্ত্রীসহ নমিনেশন প্রত্যাশীরা। কেন্দ্রীয় রাজনীতি, ওমরাহ ইত্যাদির নামে নেতাদের কেউ কেউ খরচপাতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। এবার তা পারছেন না। এবার হিসাব ভিন্ন। পলিটিক্সের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ইকোনমিক্সের কিছু ব্যাপারও।

এবার গোটা রমজানেই নেতাদের অনেকে নিয়মিত এলাকায় গেছেন। থেকেছেন। খরচপাতি করতে হয়েছে। ইফতার পার্টি, দান-খয়রাত, ঈদ গিফট, ঈদকার্ড, রঙিন পোস্টার ছাড়তে হয়েছে আগেভাগেই। এগুলো জনপ্রিয়তা, নমিনেশন, ভোটসহ এলাকায় অস্তিত্ব ও খবরদারিতে ম্যাটার করে।

সচরাচর মানুষ নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের কাছে পেতে চায়। তাদের কাছে স্থানীয় নেতাকর্মী, সমর্থকদের কিছু প্রাপ্তির মৌসুম এটা। কিন্তু নেতাদের হিসাব ভিন্ন। সামনে ভোট বা রাজনীতির কড়া অংক না থাকলে তারা এ খরচে যেতে চান না। নানান বাহানায় এড়িয়ে চলেন। এবার তা পারছেন না গতবারের মতো।

পরিস্থিতির আলোকে বেশ কয়েক জায়গায় রানিং এমপিদের ঘায়েল করার ফন্দিফিকিরে বেশ এগিয়ে গেছেন কামিংরা। কোথাও কোথাও রানিংদের চেয়ে খরচে এগিয়ে গেছেন কামিংরা। বেশি শেয়ান সিটিং এমপিদের কেউ কেউ এ অবস্থায় তামাশা দেখার পথ ধরেছেন। তারা চান নতুন মালদের কিছু মাল খসুক।

মাল খসে দুর্বল হোক। ওস্তাদের মারটা তারা দেবেন শেষরাতে। এই ফাঁকে তাদের অনেকে মক্কা-মদিনা ঘুরে আসার কৌশল নিয়েছেন। তাদের কাছে হজের খরচ এলাকার খরচের চেয়ে কম। আর মাঠে-ঘাটে থাকতে অভ্যস্তরা ঈদ-রোজাকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা ছুটছেন নিজ নিজ এলাকায়।

জোটের শরিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও নিজ নিজ এলাকার নির্বাচনী মাঠ গরম করছেন। ইফতার পার্টির মাধ্যমে মাসব্যাপী দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রচার চালিয়েছেন তারা। দুস্থদের মাঝে বিতরণ করেছেন নতুন কাপড় ও খাদ্যসামগ্রী। অনেকে এরইমধ্যে নিজ নিজ এলাকায় চলে গেছেন। ঈদ করবেন এলাকায়।

কেউ কেউ আবার কয়েক দফা এলাকায় ঘুরে এসেছেন। সক্রিয়দের পাশাপাশি দীর্ঘদিন যারা এলাকা বিমুখ ছিলেন, তারাও নির্বাচন সামনে রেখে নিজ নিজ এলাকায় পা রাখছেন। তাদের পদচারণায় বেশ জমে উঠেছে ঈদ রাজনীতি। ইফতার ছাড়াও নানা ছুতায় গ্রামে গ্রামে চক্কর দিচ্ছেন। বিনা ওয়াক্তেও ঢুকে পড়ছেন মসজিদে। এলাকাপ্রীতির জানান দিয়েছেন।

এখন ঈদ কার্ড ও এসএমএস পাঠিয়ে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নেতাকর্মী এবং এলাকাবাসীর কাছে নিজেদের উপস্থাপন করছেন। ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যানার-পোস্টারও টাঙানো হয়েছে তাদের পক্ষে। এ কৌশলে গণসংযোগসহ ভোটের অনেক কাজ সেরে ফেলতে পারছেন বলে মনে করছেন তারা।

মানুষের চাহিদা ও পরিবেশের সুযোগের সদ্ব্যবহারের কালচার এ দেশে বছরজুড়েই চলে আসছে। অতিমাত্রায় অর্থসহ নানা সুবিধা কব্জা করার জন্য তা কারো কারো জন্য সুসময়। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, রোজা যার যার হলেও মওকা যেন সবারই। জাকাত আদায়ের উত্তম মাস হিসেবে রমজানকে ঘিরে রাজনীতি, সামাজিক খবরদারির মৌসুম হিসেবে অপব্যবহারের মাত্রাও কম নয়।

সংযম চর্চার মাসটিতে অসংযমের এ ছড়াছড়ি সিয়ামের তাৎপর্যের একেবারে উল্টো হলেও দাওয়াত, হাদিয়া, খাওয়া-পরা, কেনাকাটা, মজুদ, মুনাফা, ঘুষ, চাঁদাসহ সবকিছুরই একটা উত্তম সময় হিসেবে ফায়দা লোটার মানসিকতা অনেকেরই। রয়েসয়ে বা সংযমের বদলে খাই খাইয়ের এ দুর্নিবার প্রতিযোগিতায় তাদের সবারই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সাধ। রাজনীতিকরা এ সুযোগ অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই বোঝেন।

অনৈতিক মনে হলেও রমজান-ঈদ আমাদের অর্থনীতিতে কিছু জোগানও দিচ্ছে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সওয়াব-গুনাহ এক্ষেত্রে কেমন যেন আপেক্ষিক হয়ে গেছে। অন্য যে কোনো সময় বা উৎসরের চেয়ে এ মৌসুমে অর্থের লেনদেন ঢের বেশি। রোজার আগেই রোজার আমেজ শুরু হয়ে যায় নিত্যপণ্যের বাজারে। কারো কারো ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয় রোজা শুরুর পরপরই। তা চলে গোটা রমজান জুড়ে। ঈদের দিনই শেষ হয় না। রেশ থাকে আরো ক’দিন। রোজা শুরুর আগে থেকে পোশাক, খাবার, পরিবহন খাতসহ সব জায়গায় লেনদেন শুরু হয়। নিশ্চিৎ হয় লাভ।

লোকসানের কোনো ঝুঁকিই থাকে না। এ সময় জিনিসপত্রের দাম বেশ বেড়ে যাওয়া মানুষের কাছে সহনীয়। রোজায় নির্বিচারে পকেট কাটার শিকার হতে মানুষও যেন প্রস্তুত হয়েই থাকে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালা-পার্বণে ব্যবসায়ীরা মালসামানা বিক্রি করে নামমাত্র লাভে। আমরা বিধর্মী-অধর্মী বলে শান্তি পাই- এমন দেশেও এ দরদি রেওয়াজ আছে। তাদের কাছে এটি সওয়াবের কোনো ব্যাপার নয়। নৈতিকতার বিষয়।

পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ (থ্যাংকস গিভিং ডের পরদিন), ‘বক্সিং ডে’ (বড়দিনের পরদিন) কেনাকাটার বড় উপলক্ষ হিসেবে ফিরে আসে প্রতিবছর। খ্রিস্টান ধর্মের বৃহৎ উৎসব বড়দিনের আগে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এবং পূজায় ভারত-নেপালে বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে মাঝারি মাপের দোকানে ছাড় দিয়ে থাকে।

ইউরোপের ‘বক্সিং ডে’র মতো কেনাকাটার দিন আছে চীনেও। ওই দিনটিতে চীনা ক্রেতারা প্রায় সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বড় অংশ কেনে। এর অন্যতম কারণ মূল্যছাড়। প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য মেলে এই দিনটিতে। থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে ছাড় দেয়। মুসলিম দেশ ইরানে ঈদ, শবেবরাত, রমজানের আগে যে কোনো জিনিসের দাম বাড়ানো গুরুতর অপরাধ হিসেবে দণ্ডনীয়।

সেখানে মুসলিমপ্রধান এ দেশে ব্যবসায় ঈদ-রোজা, কোরবানির মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো বাড়তি মুনাফার টেকসই মৌসুম। ইফতার-সেহরি মিলিয়ে ভূরিভোজও বেশি। গলির বখাটে থেকে শুরু করে নেতা, আতি-পাতিদের চাঁদার নামে ‘তোলা’ আদায়ও বেশি। মৌসুমটাতে খাদ্যে ভেজালের ক্রিয়াকর্মও বেশি। বাজার সয়লাব বিষাক্ত, ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যে। ফলে রমজানজুড়ে অধিক ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য।

ফুটপাতের ভাসমান দোকান থেকে শুরু করে যুগ-যুগের প্রচলিত হাটবাজার, রেস্তোরাঁ কিংবা হালের আধুনিক চেইনশপগুলোতে প্রায় একই কাণ্ড-কারখানা। খাদ্যে ভেজাল, ফলে কেমিক্যাল মেশানোর মাত্রা এ মাসেই বেশি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও বেশি। এ মাসে পুলিশের পকেটও বেশি ফুলে ওঠে চাঁদার টাকায়।

ইফতারে বেগুনি বিক্রি করা সরু গলির ছোট্ট দোকানদার থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্যের বড় মিল মালিক, যে যতটা পারে দেশবাসীর মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে সচেষ্ট। সংযম-ঈদ, পবিত্রতার নামে এ নোংরামিতে পূণ্য হাসিল হয়, না বরবাদ হয়- এ বিতর্ক অনেক দিনের হলেও তা পানসে। অবান্তর। ফয়সালাহীন।

অংক, হিসাব, লাভের কাছে নৈতিকতা অবান্তরের মতোই। ঈদের সময় মানুষের যাতায়াত বাড়ে অসম্ভব মাত্রায়। একে তো রাস্তাগুলোর বেহাল দশা, তার ওপর অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে রাস্তাঘাটের অবস্থা আরও গুরুচরণ। ঈদ সামনে রেখে রাস্তা মেরামতের কাজেও অর্থনীতি কাজ করে। এ সময় দ্রুত ও যেনতেনভাবে রাস্তা মেরামত করে ঠিকাদাররা বড় অঙ্কের টাকা কামিয়ে নেন। এখানে আরও বড় অর্থনীতি কাজ করে। ফিটনেসহীন গাড়ি ও লঞ্চ নামানোর পেছনেও বড়সড় অর্থনীতি কাজ করে।

রেলপথে অধিক ভাড়া হাতানোর সুযোগ না থাকলেও রয়েছে টিকিট কালোবাজারি। শহর থেকে গ্রামে গিয়েও রক্ষা নেই। গ্রামে ছোট ছোট যানবাহনের চালকরাও এ সময় বাড়তি ভাড়া আদায় করে। ঈদের আর এক অর্থনীতি ছিনতাই। এ সময় সরস থাকে ছিনতাইকারী ও মলম পার্টির লোকজন। মানুষের চলাচলের ভিড়ে সহজেই সুযোগ কাজে লাগায়। এর বিপরীতে চলে সাধারণ মানুষের কষ্টের অর্থনীতি। পদে-পদে, পথে-পথে শুধু কষ্ট, হয়রানি আর পকেট কাটার অর্থনীতি।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন