বিএনপি কাকে বিশ্বাস করে- বাংলাদেশের জনগণ নাকি ভারতকে?
বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ভারত সফর করেছেন এবং ভারতীয় পত্রপত্রিকার বরাতে আমরা জানতে পারি যে, বিএনপি নেতৃবৃন্দ ভারতের কাছে বাংলাদেশে একটি “অবাধ-নিরপেক্ষ-নির্বাচন” দাবি করেছেন এবং এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ মনে করে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ভারত, অতএব আগামী নির্বাচনে ভারত যদি বিএনপিকে নির্বাচনে বিজয়লাভে সাহায্য না করে তাহলে এবারও তারা জয়লাভ করতে পারবে না।
একথা যদিও তারা স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, বিএনপি একথা এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে যে, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে ভারতের সহযোগিতা (পড়ুন ব্লেসিংস) থাকতে হবে, নাহলে বিএনপি’কে হয়তো রাজনীতি থেকেই বিদায় নিতে হতে পারে। সত্যিই কি তাই? বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ভারতে গিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন বা তারা কোন্ বিষয়টি নিয়ে মূলতঃ কথা বলেছেন, তা আমরা সকলেই কমবেশি জানি, তাই সে বিষয়ে না গিয়ে এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি যে, এতোদিন আওয়ামী লীগকে যে রাজনৈতিক দলটি অর্থাৎ বিএনপি যে ভারত-তোষণের দায়ে অভিযুক্ত করে কখনও ফেনী পর্যন্ত ভারতকে দিয়ে দিয়েছে, বাঙালি মুসলমানকে মসজিদে ঊলুধ্বনি শুনিয়েছে সেই বিএনপি-ই কেন হঠাৎ এতো ভারত-পছন্দ রাজনৈতিক দল হয়ে উঠলো? নিশ্চয়ই এর পেছনে রয়েছে নিগূঢ় কোনো কারণ এবং প্রথমেই সে ব্যাখ্যা দিয়েছি যে, বিএনপি মনে করছে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে ভারতকে ‘কর’ দিতে হবে।
আবার একথা কিন্তু কেবল বিএনপির ভারত ভ্রমণে যাওয়া নেতৃত্ব মনে করছে না, একথা জোরেশোনেই সর্বত্র শোনা যাচ্ছে যে, এই নির্দেশ তারেক জিয়াই বিএনপি নেতৃত্বকে দিয়েছেন লন্ডন থেকে। তার মানে বিএনপি’র ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ মেনে নিয়েছেন। তাহলে এখন থেকে আর আমরা এদেশে ভারত-বিরোধী রাজনীতি দেখবো না এবং বিএনপি আর কোনো ভাবেই আওয়ামী লীগকে ভারতের ‘দালাল’ বলে গাল দিতে পারবে না। বিএনপি সেই জায়গা থেকে নিজের স্বার্থেই সরে এলো বলে ধরে নেয়া যায়।
কিন্তু বিএনপি’র এই ভারত-প্রিয়তা কি দলটির নেতাকর্মীরা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন উন্মুক্ত এবং মানুষের মনোভাব জানার একটি উৎকৃষ্ট উপায় বলেও মোটামুটি স্বীকৃত। দেশের চিহ্নিত বিএনপি-পন্থী ফেইসবুক সেলিব্রেটি বলে যারা ইতোমধ্যে জনপ্রিয় তাদের কেউ কেউ এই প্রশ্নই তুলেছেন যে, যে দোষে আওয়ামী লীগ দুষ্ট সেই দোষ বিএনপি করতে গেলো কেন? বিএনপি’রতো নিজস্ব রাজনীতি আছে, যার মূলেই রয়েছে ভারত-বিরোধিতা, সেখান থেকে সরে আসার কোনো কারণ আছে কি?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের মানুষের ওপর নির্ভর না করে বিএনপি কেন এখন ভারতের কাছে গিয়ে নিজের কোল পেতে দিচ্ছে? একথাতো সর্বজনবিদিত যে, ভারত নিজের স্বার্থ ছাড়া কাউকে কিছুই দেয় না, বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে দেশের জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ভারতের কাছে গিয়ে হাত পেতে বিএনপি ভালো কাজ করেনি- এই কথাগুলো কিন্তু আমার নয়, বিএনপি-পন্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় ব্যক্তিরাই এসব প্রশ্ন তুলেছেন। বিএনপি-সমর্থকদের কেউ কেউ আরো জোর দিয়েই একথাটি বলতে চাইছেন যে, আওয়ামী লীগের চেয়েও ভারত-প্রেমিক একটি রাজনৈতিক দল এই মুহূর্তে ভারতের প্রয়োজন থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু সেই দায়টি বিএনপি নিতে চাইছে কেন? বাংলাদেশের মানুষ বিএনপি’কে ভোট দেয়, ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে দেখেই, ভারত-প্রেমের জন্য যারা ভোট দেয় তারা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে, বিএনপি’কে নয়, তার মানে এতোদিন যারা ভারত-বিরোধিতার জন্য বিএনপি’কে ভোট দিতো, তারাও এখন থেকে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে, কারণ ভারত-প্রশ্নে এখন আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’তে কোনো পার্থক্য নেই। জানি না, বিএনপি তার সমর্থকদের এসব যুক্তি শুনছে কিনা? কিন্তু আমার প্রশ্ন সেটি নয়, আমার প্রশ্নটি ভিন্ন।
ভারত প্রকাশ্যেই এই মুহূর্তে গদগদ হয়ে বলছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটি সম্পর্কের নতুন মাত্রায় অবস্থান করছে এবং তারা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে নতুন কোনো ভারত-বিরোধী তৎপরতা হওয়ার কোনো আশঙ্কা করছে না, যা এতোদিন দেশটির মুখ্য দুঃশ্চিন্তার কারণ ছিল। ভারতীয় পত্রপত্রিকা খুললেও এই কথাটি প্রথম বাক্যেই লেখা হয় যে, বাংলাদেশই এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় মিত্র।
ইতোমধ্যেই ভারতের চারপাশে মুক্তোর মালার মতো একটি ভারত-বিরোধী বলয় তৈরি হয়েছে, যা ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এমতাবস্থায় কোনো ভাবেই একটি পরীক্ষিত বন্ধুকে হাতছাড়া করা ভারতের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভারতেও মোদি সরকার ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে এবং একটি নির্বাচন আসন্ন প্রায়। ঠিক এই সময়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দের ভারত সফর, থাইল্যান্ডে ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের কথিত গোপন বৈঠক কিংবা লন্ডনে ভারতের সঙ্গে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি-হাই কমান্ডের দরকষাকষির খবরের সত্য-মিথ্যে যাচাই না করেই এই প্রশ্নটি তোলা যায় যে, বিএনপি ভারতের কাছে কী চাইছে? আর বিনিময়ে ভারতকে কিই-ই বা দিতে চাইছে?
আজকে এ প্রশ্ন তোলা অবান্তর যে, শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে কী কী দিয়েছে, কারণ এসব আর কোনো গোপন বিষয় নয়, দশ বছরে এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন এই প্রশ্নটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারত কি আসলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না, কারা আসবে কারা আসবে না, কারা নির্বাচনে জয়লাভ করবে কারা করবে না- এসব সবই যদি ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ বা রাজনীতির কাজটি আসলে কি? স্বীকার করতেই পারি যে, ভারত একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র।
প্রতিবেশীর ওপর তার চাপ দেওয়ার ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত কি এতোটা সক্ষমতার সঙ্গে রাজনীতি, নির্বাচন ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো বাস্তব উদাহরণ কি আছে? অনেকেই বলবেন যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ভারত করিয়েছে। তর্কের খাতিরে সেকথা যদি মেনেও নেই তাহলেও কি একথা প্রমাণ করা সম্ভব যে, জনসমর্থন ছাড়া আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে?
ভারতকে কেন আমরা এতোটা শক্তিশালী বা বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমতার চেয়েও ক্ষমতাবান মনে করছি যে, তারাই এদেশে নির্বাচন, সরকার পরিবর্তন ও সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সক্ষম, আর বাংলাদেশের জনগণ, রাজনীতিবিদ ও সরকার সবই দুধভাত? এই মুহূর্তে আমার বিশ্বাস আমাদের মৌলিক প্রশ্নটি হওয়া উচিত এটাই।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ ভারতে গিয়েছেন তাদের রাজনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সাগরে ভাসমান মানুষ খড়কুটো ধরেও ভেসে থাকতে চায়। যে রাজনৈতিক দুর্দশায় দলটি পড়েছে তাতে তাদের সামনে বিকল্প কিছু নেইও, এতে তাদের দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বাংলাদেশকে যে একেবারে নিঃস্ব করে ফিরে এসেছেন, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাদের নোংরা ভারত-বিরোধীতা যেরকম নিন্দনীয় ও বাংলাদেশকে আসলে প্রায় ‘অস্তিত্বহীন’ই করে তোলে, তেমনই তাদের এই নয়া ভারত-প্রেম বাংলাদেশ ও দেশের জনগণকেই ‘দেউলিয়া’ করে, দেশ ও জনগণের সম্মান তাতে এক চুলও বাড়ে না।
আওয়ামী লীগ অবশ্য একথা বার বারই বলে যে, মুখে ভারত-বিরোধী হলেও বিএনপি-ই বাংলাদেশে ভারতকে অনৈতিক ও বাংলাদেশের স্বার্থ-বিরোধী সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। আর আওয়ামী লীগ দু’টি প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যেরকম দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক হওয়া উচিত ঠিক সেরকম দেয়া-নেয়ার সম্পর্কই নিশ্চিত করে আসছে শুরু থেকে।
এখন বিএনপি যেভাবে হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে তারা ভারত-বিরোধিতা করবে না বলে নাকে খত দিচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগের এই দাবিকেই চরম সত্য বলে মনে হয়। বিএনপি নিজেই আওয়ামী লীগের এই দাবির সত্যতাকে নিশ্চিত করেছে।
আমরা এখনও জানি না যে, বিএনপি কী কী প্রতিশ্রুতি ভারতকে দিচ্ছে। শেখ হাসিনা প্রায়শঃই বলেন যে, ২০০১ সালে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করেননি বলে তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেননি, আর বেগম জিয়া সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু দুঃখজনক ভাবে তখন গ্যাস পাওয়া যায়নি। তারেক জিয়া বাংলাদেশে টাটাকে ব্যবসা দেওয়ার সকল আয়োজন করেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এখন হয়তো নতুন নতুন প্রতিশ্রতি দেওয়ার ঘটনা ঘটবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম দৃঢ়ভাবেই এখনও পর্যন্ত বিএনপি-বিরোধীই বলে লক্ষ করা যায়। তবে তারা খাঁটি দেশপ্রেমিকের মতো ভারতীয় স্বার্থের সকল ডিম এক ঝুড়িতে না রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি ভারতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে বিএনপি’কে ক্ষমতায় আসতে হয় তাহলে আবারও সেই প্রশ্ন মুখ্য হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে অসুবিধে কিসে?
এটা হয়তো যুক্তির প্রশ্ন, কিন্তু আমার কাছে এখনও এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ যে, কেন বিএনপি বার বার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের ওপরে ভারতের ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে? বা দিতে চায়? দেশ ও দেশের মানুষকে একবারের জন্যও কি বিশ্বাস করতে পারে না দলটি? এর আগে যদি দেশের মানুষ তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে থাকতে পারে এবার কেন পারবে না, সে প্রশ্নটিই আমি বিএনপি’র সামনে রাখতে চাই। আমি নিশ্চিত যে, এই প্রশ্নটি আমার একার নয়, বাংলাদেশের সকল জনগণেরই।
ঢাকা ১১ জুন, সোমবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/পিআর