যত দোষ, নন্দ ঘোষ
মানুষ ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়, তারপর বড় থেকে আবার আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। তাই বয়স্ক মানুষের মধ্যে একধরনের শিশুসুলভ ব্যাপার থাকে।
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মধ্যেও সেই শিশুসুলভ ব্যাপার রয়েছে। তার হাসি, তার কথা আমার দারুণ লাগে। তার হাসিতে চমৎকার একটা সারল্য আছে। তার ‘রাবিশ’, ‘নাথিং’ ধরনের কথাবার্তা আর সবার মত আমাকেও বিনোদন দেয়। একজন সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে তার প্রজ্ঞায় আমার দারুণ আস্থা।
আর যিনি টানা ১০ বার এবং মোট ১২ বার বাজেট পেশ করেছেন, তাঁর ওপর আস্থা না রেখে উপায় নেই। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন ৮৫ বছর বয়সী মুহিত হুটহাট রেগে যান। এটা ঠিক সৎ এবং সরল মানুষ রাগেন বেশি। তারা অন্যদের মত কৌশলী হতে পারেন না। মনে রাগ পুষে রেখে মুখে ডিপ্লোম্যাটিক হাসি ধরে রাখতে পারেন না। কিন্তু মাননীয় অর্থমন্ত্রী ভুলে যান, `রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।‘
গত ৮ জুন বাজেট উপস্থাপনার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বারবার ক্ষেপে যান। নির্বাচনের বছরে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বিশাল বাজেট দেয়ার পর অর্থমন্ত্রীর রেগে যাওয়ার মত কোনো ঘটনা ঘটেনি। ধরে নিচ্ছি, সাংবাদিকরা না বুঝেই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু তাতে অর্থমন্ত্রী ক্ষেপে যাবেন কেন। তিনি ভুলটা ধরিয়ে দিলেই হলো। সাংবাদিকরা প্রশ্ন দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবেন। অর্থমন্ত্রী যুক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করবেন। রাগ করলে হবে না।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ যে গোটা বিশ্বেই উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, তার কৃতিত্ব অনেকটাই ৮৫ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রীর। এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিছক এগিয়েছে না বলে, বলা ভালো বদলে গেছে। আগে যে অর্থনীতি গুটি গুটি পায়ে হাঁটতো, সে অর্থনীতি এখন রীতিমত লাফিয়ে, দৌড়ে চলে।
এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বাংলাদেশ পরিণত জয়েছে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে। যোগ্যতা অর্জন করেছে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, রপ্তানি বেড়েছে, আমদানিও বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি কমেছে, দারিদ্র্য কমেছে। সব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর এবং অভাবনীয়। অর্থমন্ত্রী অনেক ভালো করেছেন। কিন্তু ভালোর কোনো শেষ নেই। তাই বাজেটের সমালোচনা করা যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই।
নির্বাচনের বছরের বাজেট বলে সবাই একে বলছেন, জনতুষ্টির বাজেট। জনগণকে তুষ্ট রাখাই তো একটি সরকারের প্রধান চাওয়া। সেটা যদি হয়, মন্দ কি। অর্থমন্ত্রী বলছেন, শুধু এবারেরটি নয়, তার সব বাজেটই নির্বাচনী। কারণ তারা জনগণের কল্যাণ চান।
বাজেট প্রস্তাবনায় বাড়তি করারোপ না করে বিভিন্ন মহলকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা কখনোই সম্ভব নয়। এটা ঠিক, এবারের বাজেটে বড় সমালোচনার জায়গা খুব বেশি নেই। কিন্তু ছোট খাটো অনেক বিষয় দিয়ে বাজেটের টার্গেটটা বোঝা যায়।
যেমন এবারের টার্গেট মনে হয় মধ্যবিত্ত। অবশ্য মধ্যবিত্তরা সারাজীবনই সবার টার্গেট। মধ্যবিত্তরা সবসময় মাঝে থেকে পিষ্ট হয়। প্রবল আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মধ্যবিত্তরা না পারে হাত পাততে, না পারে বড় লোকি দেখাতে। মধ্যবিত্তদের কোনো সমিতি নেই। ব্যবসায়ীদের মত তারা চাপ দিয়ে দাবি আদায় করতে পারে না।
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে এ সীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। কিন্তু এবারও তা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বছরে আড়াই লাখ টাকা মানে মানে ২০ হাজার ৮৩৩ টাকা হলেই আপনাকে আয়কর দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন টিআইএন আছে এমন মানুষের সংখ্যা ৩৩ লাখ। এরমধ্যে আয়কর দেন মাত্র ১৬ লাখ।
এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! ঢাকার রিকশাওয়ালার আয়ও মাসে ২১ হাজার টাকার বেশি। মাসে ২১ হাজার টাকা আয় করেও চারজনের পরিবারকে প্রায় বস্তিতে থাকতে হয়। মধ্যবিত্তসুলভ সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা হয়। অথচ মাসে লাখ টাকা আয় করা অনেকেও আয়কর দেন না। কর জালের বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠিকে সরকার ধরতে পারে না, পারে শুধু সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের সাথে।
এবারও করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়িয়ে সরকার আসলে মধ্যবিত্তদের জন্য ফাঁদ পেতেছে। গত অর্থবছরে যাদের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা ছিল, এবার যদি এক হাজার ইনক্রিমেন্ট পান, তাহলেই তারা করের আওতায় চলে আসবেন। তাদের অবস্থা হবে ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলা। আয়কর জালে আটকে গেলে তাদের বেতন কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে।
বাস্তবতা হলো, মাসে ২১ হাজার টাকা আয় করেন, এমন মানুষের কাছ থেকে আয়কর চাওয়া অন্যায়, তাদের আসলে আয়কর দেয়ার সামর্থ্য থাকে না। চাকরিজীবীদের আয়কর ফাঁকি দেয়ার দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের আগাম আয়কর দিতে হয়। সরকারের উচিত মনোযোগটা এদের দিক থেকে সরিয়ে, কর জালের বাইরে থাকা রাঘব বোয়ালদের ধরা।
বলছিলাম বাজেটের মূল সুর মধ্যবিত্তের জন্য অস্বস্তিকর। ব্যাংক মালিকরা ছাড় পেয়েছেন, মধ্যবিত্তরা পাননি। মধ্যবিত্ত যারা একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান, তাদের ওপরই খড়গটা নেমেছে বেশি। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম বেড়েছে। যারা গাড়ি কিনতে না পেরে উবার-পাঠাও চড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চান, সেখানেও কর বসেছে। যাদের দুটি গাড়ি আছে বা ঢাকায় ৮ হাজার বর্গফুটের বেশি ফ্ল্যাট আছে; তাদের সারচার্জ দিতে হবে।
ভালো কথা। কিন্তু বাড়িওয়ালারা সারচার্জের টাকাটা ভাড়াটেদের কাছ থেকেই আদায় করবেন। তাই চাপটা সামলাতে হবে মধ্যবিত্তকেই। ভাড়া থাকতে যাদের অপছন্দ, ভেবেছেন ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট কিনবেন; ১১০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম কিছুটা বাড়বে। আর ১১০০ থেকে ১৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম একটু কমবে। বাড়া-কমাটা খুব বেশি নয়। কিন্তু টার্গেট কিন্তু মধ্যবিত্তরাই। অর্থমন্ত্রী সুন্দরীদের প্রতিও সদয় নন। দাম বাড়ছে প্রসাধন সামগ্রী, সুগন্ধীর।
বাজেট প্রস্তাবনা পেশের পর একজন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই বাজেটে সাধারণ মানুষের কী উপকার হবে? আসলে সাধারণ মানুষের উপকার কমই হয়। সব চাপটা সামলাতে হয় এই সাধারণ মধ্যবিত্তদেরই। মধ্যবিত্তরা হলো নন্দ ঘোষের মত। বড় লোকদের এক-দুই শতাংশ কর কম বেশি হলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু মধ্যবিত্তদের পাই-পয়সা গুনে সংসারের বাজেট করতে হয়। চালের আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
কৃষকরা যাতে ধান-চালের ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্যই এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সাথে সাথে বাজাওে চালের দাম বেড়ে গেছে। এই চাপটাও মধ্যব্দিদেও ওপর দিয়েই যাবে। আমি নিশ্চিত এর সুফল কৃষকরা পাবে না। চালের দাম বাড়লেই মধ্যবিত্তের বাজেটে টান পড়বে। ধরুন যারা নিয়মিত উবার বা পাঠাও ব্যবহার করেন; তাদের মাসে হাজার টাকা ব্যয় বেড়ে যাবে। এভাবে মধ্যবিত্তদের মাথা ঢাকলে পা উদোম হয়ে যাবে।
বাজেট মাত্র প্রস্তাব করা হয়েছে। মাসজুড়ে আলোচনা শেষে ৩০ জুন পাস হবে। পাসের সময় যেন মধ্যবিত্তের স্বস্তির জায়গাটা মাথায় থাকে, এই প্রত্যাশা থাকলো।
১০ জুন, ২০১৮
এইচআর/পিআর