ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধর্মের দেশে অধর্মের বেসাতি

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১১:৫২ এএম, ২৯ মে ২০১৮

বাংলাদেশের মেয়েদের পদে পদে বিপদ। এই দেশে মেয়েদের সবচেয়ে বড় বিপদটি ঘটে এদেশের পুরুষের কাছ থেকেই। শুধু এদেশে কেন, পৃথিবীর সর্বত্রই মেয়েদের প্রধানতম বিপদের কারণ পুরুষ। এই সত্য দীর্ঘকাল ধরে অপরিবর্তনীয়। কঠোর আইন কিংবা ধর্ম- কোনো কিছু দিয়েই পুরুষ নামক এই বিপদের হাত থেকে নারীকে কোনো ভাবেই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না সে বিষয়টি নিয়ে নানা প্ল্যাটফরমে আলোচনা চলে সর্বত্র, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো সঠিক পথ পাওয়া যাচ্ছে না যে পথে নারীমুক্তি আসতে পারে।

বাংলাদেশের কথাই ধরি। এদেশে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নারীর যে অভানীয় উন্নয়ন ঘটেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে, সমাজে এবং রাষ্ট্রেও। নারীর এগিয়ে আসার ফলে দেশের একটি প্রধান অর্থ উপার্জনকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্পে বিপ্লব এসেছে। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ দেশের চেহারাটিই বদলে দিয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অচলায়তনের কথা আমরা বারবার বলে থাকি সেই অচলায়তন থেকে কি নারীকে মুক্ত করা গিয়েছে? বিশেষ করে পুরুষের অত্যাচার, নির্যাতন ও সহিংসতা থেকে কি নারীকে মুক্ত করা গিয়েছে?

অনেকেই বলবেন যে, এদেশে আইন নেই, আইনের প্রয়োগ নেই তাই নারীর প্রতি পুরুষের হাতে ঘটা সহিংসতা থেকে নারীকে মুক্ত করা যাচ্ছে না। মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকে সমর্থন করেন অসংখ্য মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, একই শাস্তি কি নারী নির্যাতনের জন্য কিংবা ধর্ষণের জন্য কোনো পুরুষকে দেওয়া যেতে পারে? আমি নিশ্চিত যে, অনেকেই বলতে চাইবেন, সেটা একটু বেশি বেশিই হয়ে যাবে, কারণ, নারীর জীবন অতি তুচ্ছ বিষয়, এর জন্য পুরুষকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা হয়ে যাবে বাড়াবাড়ি। আমি নিজেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতি নই কিন্তু আমি বোঝাতে চাইছি যে, নারীর ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও কী ভয়াবহ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তারপরও শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নারী নিজের ভাগ্যোন্নয়ন নয় বরং পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছে, এমনকি পাড়ি দিচ্ছে বিদেশেও।

বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচে শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়েছে সেই আশির দশক থেকেই। মধ্যপ্রাচ্যের আজকের যে চেহারা তাতে বাঙালি শ্রমিকের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় দেখা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলি বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া নিজেদের অর্থনৈতিক মন্দাকালেও শ্রমিক নেয়া বন্ধ রাখে। অপরদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি দৃঢ় ভিত্তি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শ্রমিকদের এই আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রিজার্ভ নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার খুউব গর্ব করে তা মূলতঃ এই শ্রমিকদের পাঠানো অর্থই।

বিভিন্ন অজুহাতে বিশেষ করে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ নেই কিংবা কাজের অভিজ্ঞতা নেই ইত্যাদি ধুয়া তুলে বাংলাদেশ থেকে আগের মতো শ্রমিক নেওয়ার ঘটনাটি ঘটছে না। তবুও সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। আমরা জানি যে, অনেক দেন-দরবারের পর সৌদি আরব রাজি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার জন্য। বিশেষ করে গৃহকাজের জন্য নারী শ্রমিক নেওয়ার ব্যাপারে সৌদি আরব সম্মত হয়েছে এবং সেটা খুউব অল্প খরচেই। তবে একথাও জানা যায় যে, সরকার আসলে নারী শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘এমওইউ’ বা সমঝোতা স্মারক সই করে পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করতে চেয়েছে। কৌশল হিসেবে বিষয়টি খারাপ ছিল না, যদি নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার আরো একটি ‘কৌশলী’ হতো।

সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকরা এতোদিন ধরে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও নেপাল থেকে গিয়ে কাজ করতো। এই রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ফিলিপাইন তাদের নারী শ্রমিকদের বিদেশে কাজে পাঠানোর আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণতো বটেই, সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতি ও অল্প ভাষা-জ্ঞান দিয়ে তবেই সেসব দেশে নারীদের কাজ করতে পাঠাতো। একই সঙ্গে এই নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথমতঃ সরকারি পর্যায়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা এবং বেসরকারি পর্যায়ে যে সব এজেন্সির মাধ্যমে নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানো হয় তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশে কার্যালয় খুলে নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে তবেই তাদেরকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর লাইসেন্স দেয়। ভারত ও নেপালের ঘটনাও প্রায় অভিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবে পাঠানোর ঘটনা খুব বেশিদিন নয় যে শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার পর থেকে একাধিক এজেন্ট বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকদের পাঠানোর কাজটি শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব নারীদের পরিবারের পুরুষ সদস্যকে উল্টো অর্থ পরিশোধ করে তবেই এইসব নারীদের সৌদি আরবে কাজে পাঠানো হয়।

মাস খানেক যেতে না যেতেই এইসব নারীরা সৌদি আরব থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসতে থাকে। সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ খোলেন না, কারণ তাতে সামাজিক ভাবে, পারিবারিক ভাবে তাকে নতুন করে নিগৃহীত হতে হয়। কিন্তু তারপরও যে ক’জনের কথা আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি তাদের কথা শুনলে মনে হয় কীসের কি ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকারের যুগ, সৌদি আরব আসলে তার চেয়েও পিছিয়ে পড়া একটি রাষ্ট্র। যেখানে নারী মাত্রেই ভোগের বস্তু এবং নারী মাত্রেই নির্যাতন ও নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু। অথচ রাষ্ট্রটি একটি শক্তিশালী ধর্মের ঠিকেদারি নিয়ে বসে আছে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশী বা অন্য যে কোনো দেশের নারী শ্রমিকের ওপর সৌদি পরিবারের পুরুষ বা নারী সদস্যদের এই অত্যাচার নির্যাতন বন্ধে কি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছে? ফিলিপাইন সৌদি আরবে নারী শ্রমিক সরবরাহ এখন কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু শুরুতে ফিলিপাইনের নারীদের সৌদি পরিবারের এই অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেই টিকে থাকতে হয়েছে। একথা সত্য যে, ফিলিপাইনের নারীদের বেশিরভাগই সামান্য হলেও লেখাপড়া জানা এবং সে দেশের উদার সমাজব্যবস্থার কারণে নিজেদের আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে শুরু থেকেই জ্ঞাত। এমনকি তার অধিকার সম্পর্কেও সে সজাগ। কিন্তু বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে যারা সৌদি আরবে কাজ করতে যাচ্ছেন তাদের হয়তো ঢাকার পরেই সৌদি আরবের কোনো শহরই দ্বিতীয় শহর যেখানে তারা কাজ করতে গিয়েছেন।

অল্প দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণে কারো পক্ষেই আরবির মতো একটি কঠিন ভাষা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বা এজেন্সিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েই পাঠানো হচ্ছে কিন্তু ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যায় যে, যা দু’একটি আরবি শব্দ তারা উচ্চারণ করেন তার কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। বিদেশ-বিভূঁইয়ে একলা নারী একটি অপরিচিত পরিবারের জন্য কাজ করছেন, এমনিতেই তার মানসিক অবস্থা হওয়ার কথা ভয়াবহ, তার ওপর যদি তাকে নির্যাতন করা হয় তাও আবার যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অত্যাচার, তাহলে সেই নারীর অসহায়ত্ব পৃথিবীর কোনো মাপকাঠিতেই মাপা সম্ভব নয়। এমনকি দেশে ফিরে এসে এই নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী যে তার পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের সমর্থন-সহযোগিতা পাবেন সেটিও নিশ্চিত নয়। তাহলে এই নারীটি কী করবেন? হয় মুখবুজে এই অত্যাচার সহ্য করবেন এবং মাসে মাসে দেশে টাকা পাঠিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবেন না হয় পালিয়ে বা সুযোগ করে দেশে ফিরে এসে পরিবারের সদস্যদের নতুন নির্যাতন, সমাজের অন্যান্যদের কাছে খোঁচা শুনবেন এবং শেষ পর্যন্ত তার কাছে পথ হিসেবে বাকি থাকবে দুটো, হয়, এক. আত্মহত্যা ; নয়, দুই. নিজেকে নিলামে তোলা। খুব কঠিন শোনালেও নির্মম বাস্তবতাই হলো এটা।

অথচ যদি সরকারের পক্ষ থেকে এজেন্সি লাইসেন্স দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হতো যে, যারাই সৌদি আরবে বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে শ্রমিক পাঠাবে তাদেরকেই সেসব দেশে কার্যালয় খুলতে হবে এবং একটি নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক তৈরি করে তবেই বিদেশে নারী শ্রমিকদের পাঠানো যাবে। আমরা প্রায়শঃই বিদেশে অবস্থানরত পুরুষ শ্রমিকদের অভিযোগ থেকে জানতে পারি যে, সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস শ্রমিকদের বিপদে-আপদে সামান্য সাহায্যই করে থাকে। এই অভিযোগ পুরোনো এবং প্রমাণিত। এর মধ্যে যদি শ্রমিকটি হয় নারাী এবং তিনি যদি শিকার হন যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের তাহলে তিনিও যদি বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা না পান তাহলে তার আসলে যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকে কি?

সৌদি আরবকে আমরা পবিত্র ভূমি বলে মানি, কথায় কথায় আমরা সৌদি আরবের গল্প শোনাই। প্রতি বছর বাংলাদেশ যে বিপুল সংখ্যক মানুষ হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে সৌদি আরবকে বিপুল অর্থ জোগান দেই। মোটকথা দেশটি থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকরা যা আয় করে তা এদেশের হজ্ব পালনকারীরা আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসেন দেশটিকে। সেই দেশটি যদি নারী শ্রমিকদের সঙ্গে এরকম নিষ্ঠুর ও নিন্দনীয় অপরাধ করে তখন মানুষের ধর্মবিশ্বাস তথা সৌদি আরবের প্রতি আস্থা কমে আসাটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে ধর্ম বলে থাকে যে, তারা আইয়্যামে জাহেলিয়া বা অন্ধকারের যুগ থেকে মানুষকে মুক্ত করে বিশেষ করে নারীকে মুক্ত করেছে সেই ধর্মের উৎসস্থলেই যদি নারীর এতোটা অমর্যাদা হয় তাহলে নারীর আসলে যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকে কি?
ঢাকা ২৯ মে, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন