জলাবদ্ধতা উপভোগের প্রস্তুতি নিন
গত কয়েকবছর ধরে বর্ষাকালে ঢাকার সবচেয়ে ভোগান্তির নাম জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি এখন আর ঢাকার মানুষের ভেজার রোমান্টিকতা নয়, ডুবে যাওয়ার আতঙ্কের নাম। কয়েকবছর ধরে চললেও গতবছর জলাবদ্ধতার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। যতটুকু বৃষ্টি হয়, ঠিক ততটুকুই যেন আটকে থাকে। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকা জল থই থই। অনেকেই মজা করে ঢাকাকে নদীর সাথে তুলনা করেছেন। বড় নদী ঢাকার আবার অনেকগুলো শাখা নদী আছে- ২৭ নাম্বার, রোকেয়া সরণি, শান্তিনগর, কারওয়ানবাজার ইত্যাদি ইত্যাদি।
গতবছর বারবার জলাবদ্ধতার এক পর্যায়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আগামী বছর, মানে এ বছর জলাবদ্ধতা থাকবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে মানুষকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখা তার দায়িত্ব। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আমি তার মত অত আশাবাদী নই।
মন্ত্রীর কথায় আমার আস্থা গতবছরও ছিল না, গত একবছরে আস্থা তৈরি হওয়ার মত কিছু ঘটেনি। আমি জানি, ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা একবছরের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব নয়। একবছর কেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন কয়েকবছরেও সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগই কেবল ঢাকাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে পারে। কিন্তু বছরের কয়েকদিনের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দূর করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, যত কঠোর ও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তা কোনো জনপ্রিয়তাকামী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নেয়া কঠিন।
আমি নিশ্চিত এটা মন্ত্রীও জানেন এবং বোঝেন। তারপরও সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রশমিত করতে মন্ত্রীদের সম্ভব-অসম্ভব অনেক আশ্বাস দিতে হয়। কিন্তু মন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর ভরসা রাখার মত বোকামি আশা করি আপনারা করবেন না। মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই আশ্বাস বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। অবশ্য উদ্যোগ নিলেও একবছরের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। একেবারে নেননি, তা বলাটা ভুল হবে। সম্ভাব্য সবকিছু করেছে সরকার। ওয়াসার জন্য বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ওয়াসাও খাল খনন, পরিষ্কার, নালা পরিষ্কারের কাজ করছে। কিন্তু রোগটা ক্যান্সার, তাই টোটকায় কাজ হবে না। যদি ঢাকার সবগুলো খাল উদ্ধার করে একদম আগের মত করা যেতো, আমি নিশ্চিত জলাবদ্ধতা থাকতো না। কিন্তু জালের মত বিছিয়ে থাকা ঢাকার খালগুলো বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। কিছু বিভিন্ন সময়ে সরকারের অদূরদর্শিতায় বক্স কালভার্ট হয়ে গেছে।
কারওয়ানবাজার পর্যন্ত নৌকা চলতো, এ কথা এখন রূপকথা মনে হয়। কিন্তু বেশি পুরোনো রূপকথা নয় কিন্তু। খাল সব মেরে, ভরাট করে, দখল করে, বক্স কালভার্ট করে; পানি সরার সব জায়গা বন্ধ করে দিয়ে এখন জলাবদ্ধতা নিয়ে কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই। গাছের গোড়া কেটে আগায় যতই পানি ঢালুন, কাজ হবে না। একসময় শ্যামলী রিং রোডে দাড়ালে পশ্চিমে পুরো সাগর সনে হতো। এখনও সাগর, মানুষের আর কংক্রিটের। তো রাজধানীর সব জলাধার, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে উঁচু উঁচু বিল্ডিং বানাবেন। আবার আশা করবেন, বৃষ্টির পানি আপনার ভয়ে সুরসুর করে চলে যাবে; অতটা আশা আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্যও করে না।
অযথা সরকারকে, মন্ত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ আছে? ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও তার দায়িত্ব গ্রহণের তিনবছর পূর্তির দিনে সাংবাদিকদের জেরার মুখে জলাবদ্ধতার প্রশ্নে কোনো সুখবর শোনাতে পারেননি। সুখবর তো দূরের কথা, পত্রিকায় দেখলাম, এবার জলাবদ্ধ এলাকা আরো বাড়বে। জলাবদ্ধতামুক্ত ঢাকা গড়া কঠিন, প্রায় অসম্ভব; কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। মাদকের বিরুদ্ধে, জঙ্গীর বিরুদ্ধে, ভেজালের বিরুদ্ধে সরকারের যেমন জিরো টলারেন্স; তেমন দখলের বিরুদ্ধে একটা অভিযান দরকার।
কিন্তু যতদিন তেমন অভিযান না হবে, ততদিন কি সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? তা থাকবে কেন, থাকেওনি। দুর্ভোগ যতটা সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়, তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ বছর খালি ওয়াসাকেই বাড়তি ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে খাল খনন করতে। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই বরাদ্দ এসেছে দেরিতে। কিন্তু বর্ষা দেরি তো করেইনি, উল্টো এবার আরো বেশি জলাবদ্ধতার ইঙ্গিত নিয়ে আগাম বর্ষার মার্চপাস্ট শোনা যাচ্ছে। যে কাজ ওয়াসার মার্চে করার কথা ছিল, সে কাজ তারা করছে মে’তে। বর্ষা যখন দুয়ারে, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠই যখন প্রায় বর্ষার মতন বৃষ্টি; তখন নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি মানুষের দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তবে ওয়াসা আগে টাকা পেলে বা ফেব্রুয়ারিতে খাল খনন করলেই যে জলাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে না, সে তো আগেই বলেছি। ৪০ কোটি টাকায় যদি জলাবদ্ধতা দূর করা যেতো, তাহলে অনেক আগেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
চারপাশের নদীগুলোতে দখল আর দূষণে প্রায় মেরে ফেলে, জালের মত বিছিয়ে থাকা খালগুলোকে ভরাট করে, বক্স কালভার্ট বানিয়ে, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে প্লট-ফ্ল্যাট বানিয়ে ঢাকাকে অনেক আগেই আমরা বালতি বানিয়ে ফেলেছি। তাই যতটুকু বৃষ্টি হয়, ততটুকু পানিই আটকে থাকে। নিচে যাওয়ারও উপায় নেই। পদে পদে কংক্রিটের বাধা। এখন জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির একটাই তাৎক্ষণিক উপায়, হাতে-কলমে মানে পাম্প করে পানি বাইরে ফেলা অথবা হেলিকপ্টার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া।
কোনোটাই এখন সম্ভব নয়। তাই আসুন, হা-হুতাশ ভুলে আমরা জলাবদ্ধতা উপভোগের প্রস্তুতি নেই। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পানি নিয়ে, বৃষ্টি নিয়ে আমাদের অনেক আদিখ্যেতা, অনেক ঢং। আসুন দুর্ভোগ ভুলে, সেই পানি নিয়ে আদিখ্যেতা শুরু করি। মনে আছে ছেলেবেলায়, সম্ভবত ১৯৭৪ সালে একবার বন্যা হয়েছিল। ঘরে বসে পানি ছোঁয়া যায়, এটা ছিল আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। জলাবদ্ধতা আমাদের নস্টালজিক করে তুলতে পারে, আমরা ফিরে যেতে পারি ছেলেবেলায়।
কালিদাস থেকে হালের উদাস তরুণ; বৃষ্টি নিয়ে দু লাইন লেখেননি; এমন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। গানেও বৃষ্টি নিয়ে কত বিরহ, কত রোমান্টিকতা। আমরা যদি দুর্ভোগ ভুলে, আবারও বৃষ্টির কাব্যিক রূপটা খুঁজে বের করি; কাব্যে-সাহিত্যে-গানে দারুণ বিপ্লব হতে পারে। বৃষ্টির সময় ফুটবল খেলার আনন্দ, ডুবিয়ে গোসল করার আনন্দ, টিনের চালে বৃষ্টির ছন্দের আনন্দ, প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পাশে বসিয়ে হুড খোলা রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের কোনো তুলনা নেই। দুর্ভোগ ভুলে আসুন আনন্দে মাতি।
সাগরের নোংরা পানিতে দাপাদাপি করতে আমরা অনেক টাকা খরচ করে আমরা কক্সবাজার যাই। বর্ষাকালে চাইলে কিন্তু আপনি ঘরের সামনেই পানিতে দাপাদাপি করতে পারেন। কথা দিচ্ছি, একদম ফ্রি। সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেশি, ভাড়াও বেশি। বছরে অন্তত দুইমাস যে আপনি লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্টে থাকছেন, তার কি কোনো মূল্য নেই; দুর্ভোগটাই সব? বাড়িওয়ালা যে দুই মাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন না, তাতেই শোকর করুন।
বড় লোকদের অনেকের গ্যারেজে মাথাপিছু গাড়ি থাকে। সাথে একটা নৌকাও কিনে ফেলতে পারেন। আমাদের ছেলেবেলায় পরীক্ষায় রচনা আসতো 'জার্নি বাই বোট'। এখনও নিশ্চয়ই আসে। শহরের অনেক ছেলেকে জীবনে নৌকা না দেখে বানিয়ে বানিয়ে নৌকাভ্রমণ লিখতে হয়। একটা নৌকা কিনে নিলে আপনার সন্তানের নৌকাভ্রমণের প্র্যাকটিক্যালটা হয়ে যাবে।
বর্ষা-বৃষ্টি-পানি হলো অপার আনন্দের উৎস। লিখে শেষ করা যাবে না। সত্যি সত্যি বৃষ্টি আমার খুবই প্রিয়। ঝুম বৃষ্টি হলে আমার কাছে সব অচেনা লাগে। ঝুম বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার দারুণ লাগে। জলাবদ্ধতার একটুখানি ভোগান্তির জন্য এত আনন্দ ভুলে বৃষ্টিকে গালমন্দ করা খুবই অন্যায়।
আমরা সবসময় নেতিবাচক। গ্লাস সবসময় অর্ধেক খালি দেখি। কেন ভাই, গ্লাসটি অর্ধেক পানিতে, অর্ধেক বাতাসে ভর্তি- এভাবেও তো ভাবা যায়? সবসময় হতাশ হলে চলে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ যখন অনিবার্য, তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়। বর্ষা আসছে, উপভোগের প্রস্তুতি নিন।
২৬ মে, ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর