প্লট-ফ্ল্যাট চেটেচুটে ফোনের তলানিতে মান্যবররা
শুল্ক মুক্ত গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, শেষমেষ স্মার্ট ফোন। স্মার্ট ফোন কেনার টাকার পর দেয়া হবে বিলটাও। আর কী চান মাননীয়রা? কোন তলানিতে ঠেকেছে বেচারাদের পাওয়ার মোহ ও তাড়না? কেনই বা সরকারের এমন আচানক সিদ্ধান্ত?
সরকারিভাবে মন্ত্রী-সচিবদের মোবাইল সেট কেনার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি গত ক’দিন পথে-ঘাটেও হাসির খোরাক। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের মোবাইল ফোন কিনতে ৭৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তা ব্যবহার করা যাবে আনলিমিটেড। তারা যতো খুশি কথা বলবেন। পুরো বিলটা শোধ করবে সরকার। এসব সুবিধা রেখে সোমবার সরকারি টেলিফোন, সেলুলার, ফ্যাক্স ও ইন্টারনেট নীতিমালা-২০১৮-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
পরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সভার সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি জানান, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ যেসব কর্মকর্তা সার্বক্ষণিকভাবে মোবাইলের সুবিধা পান না, তাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার ভাতা হিসেবে মাসে পাবেন ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। এত দিন পেতেন ৬০০ টাকা করে। নতুন বিধানে বেশ কিছু কর্মকর্তার ক্ষেত্রে মোবাইল বিলের ব্যয়সীমা থাকছে না। নীতিমালাটা কার্যকর ছিল ২০০৪ সাল থেকে। এই এখন একে যুগোপযোগী করা হলো। তবে মন্ত্রিসভায় কয়েকটি অনুশাসন দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিষয়টিও। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচার-প্রধানকে রোমিং সুবিধাসহ এখানে অন্তর্ভুক্ত করার অনুশাসন দিয়েছে।
এ নিয়ে টি-স্টলেও শোনা যাচ্ছে রসালো কথাবার্তা। যার বেশিরভাগই নিম্নমানের। মান্যবরদের জন্য মোটেই সম্মানের নয়। রসিকতা করে কেউ কেউ বলছেন, দেয়া-নেয়ার বাকি আর কী থাকলো? পরবর্তী সরকার এসে তাদের দেয়ার কিছু কি থাকবে? আরেকটা প্রশ্ন-তাদের হাতে এখন যে মোবাইল থাকে এগুলোর দামই বা কতো?
ক্ষোভে-আর তাচ্ছিল্যে এমন কথাও বলা হচ্ছে, ভর্তুকি আরো লাগতে পারে। কারণ, আই ফোন ৮ ,সামসং ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে পাবে না। তাই বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে দেয়া উচিত। লেটেস্ট মডেলের মোবাইল সেটের দাম ৮০ হাজার টাকা থেকে লাখের উপরে। তাই সম্মানীয়দের ৭৫ হাজার টাকায় মোবাইল কিনতে কষ্ট হবে। হাজার হোক তারা আমাদের একনিষ্ঠ সেবক। যে কারণে মান্যবরদের নানান প্রাপ্তি নিয়ে মানুষ রসিকতা করলেও মেনে নেয়। তাদের শুল্কমুক্ত গাড়ি বাণিজ্য নিয়ে কেউ রাও করেনি। সেই গাড়ির মতো এবার ফোনের ব্যবসাও করা যাবে। এই মোবাইল সিম ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ভাড়া দিলে কিছু বাড়তি কামাই হতে পারে।
টাকা নিয়ে ফোন না কিনে ভুয়া বিল দিয়ে তা খেয়ে ফেললেই বা কী হবে? এ ধরনের অভ্যাস যে কারো কারো নেই, এমনও নয়। এখন যদি তারা ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মোবাইল ফোন সেট কেনার আগে, সরেজমিন অভিজ্ঞতা অর্জনের ডিমান্ড দেন? স্যামসাং বিষয়ে জানতে দক্ষিণ কোরিয়া বা আইফোন বিষয়ে জানতে আমেরিকা সফরে যেতে চায়? অথবা ভালোর চেয়েও ভালো অন্য কোনো মোবাইল ফোন সেট দুনিয়ার কোথায় আছে তা জানতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠানো দরকার পড়ে?
এমন লোভাতুর চর্চায় মন-মননে তারা কোথায় নামালেন নিজেদের? শুধু মোবাইল কেন? জনগণের টাকায় এমপি, মন্ত্রী, সচিবদের বউ-বাচ্চাদের জামা-কাপড় বা আরো ছোট বড় কিছু দিলেও তারা হয়তো না করবেন না। মানুষও মাইন্ড করবে না। তারা হাড়েহাড়ে মালুম করছেন মাননীয়দের রুচি-অভিরুচি। এছাড়া মাইন্ড করে ঝামেলায় পড়তে যাবে কে?
তথ্যগতভাবে বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর স্বৈরশাসকদের অন্যতম প্রধান কর্ম হল সরকারি চাকুরিজীবীদের বেশি কিছু দিয়ে বশ মানানো। সময়ে সময়ে বেতন-ভাতাসহ সুবিধাদি বাড়ানো। বাংলাদেশে তা ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে বিশেষ মডেলে চলে এসেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটিকে মোটেই সেই শ্রেণির ভাবা যায় না। বরং তাদের এ ধারার বিরোধী মনে করা হয়।
ভোট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দলটি বিশাল ঐতিহ্যধারী। ঘটনাচক্রে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতায় ঘাটতি রয়েছে বলে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন জনসম্পৃক্ত দল এভাবে আমলা সম্প্রদায়ের কাছে নেতিয়ে পড়বে? ক্ষমতায় টিকে থাকতে এভাবে নিজেকে কারো কাছে দত্তক দেবে? তোষণের মাত্রা এ পর্যায়ে চলে যাবে? –তা অনেকেরই হিসাবে মিলছে না।
উপসচিব থেকে শুরু করে তার উচ্চ পদের সরকারি চাকরিজীবীদের গাড়ি কেনার জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা ঋণ। ‘বিশেষ অগ্রিম’ নামের এই ঋণ সুদমুক্ত। আবার সেই টাকা দিয়ে কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতনবাবদ মাসে আরও ৫০ হাজার টাকা। গাড়ি মেনটেনেন্স বাবদ মাসিক নগদ ভাতার ব্যবস্থাও হয়েছে।
বাংলাদেশে এ দেয়া-নেয়ার কালচার কেবল ক্যাডার সার্ভিসে নয়। এর বাইরেও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের মিড-লেভেলের জুনিয়র বা এন্ট্রি লেভেলের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য বহু আগে থেকেই এই সুবিধা চালু আছে। একজন ক্যাডার কর্মকর্তাকে উপ-সচিব হবার জন্য যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, তার চেয়েও অনেক সহজে, কম প্রতিযোগিতায় পদোন্নতি পেয়ে আরো কম সময়ে মিড-লেভেলের জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এমন সুবিধা হাছিল হয়।
এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মাঝেমধ্যে ক্যাচাল লেগেছে। আবার স্বার্থগত কারণে ভেজাল-ক্যাচাল মিটেও গেছে। মানুষেরও তা গাসহা হয়ে গেছে। ভুলেও যায়। সেই বিবেচনা ও ঘটনার আলোকে মোবাইল ফোন কিনতে ৭৫ হাজার কেন, ৭৫ লাখ বরাদ্দ করলেও আমজনতার কিছু করার নেই। করার চেষ্টাও করবে না। পরিবারের বাদবাকি সদস্যদেরও এ নিয়মে একটা করে মোবাইল ফোন দিলেও কেউ ‘না’ করবে না।
টাকাগুলো কার? মানুষের। তাদের দেয়া ট্যাক্সের টাকা। সেই টাকায় মন্ত্রী মোবাইল কেনার ঘটনা কেমন কেমন মনে হলেও এমন খয়রাত খানেঅলাদের জন্য তা লজ্জার নয়। আরাম কেদারায় বসে ছদকা খাওয়া হজমের সঙ্গে জায়েজও হয়ে গেছে। লেটেপুটে, চেটেপুটে খেতে শরমিন্দা হন না তারা। জেলা পর্যায়েও তা সংক্রামিত। এসপি-ওসিদের চেয়েচিন্তে খাওয়া। ডিসি সাহেবদের ফ্রি-স্টাইল এল আর ফান্ড। লোকাল রিকোয়ারমেন্ট নামের ফান্ডটি একধরনের প্রশাসনিক দান বাক্সের মতো। এ ফান্ডের টাকা কিভাবে কালেকশন হয়? তা দিয়ে কী হয়- জেলা সদরের সচেতনদের তা অজানা নয়।
এর আগে, মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ি-গাড়ি বরাদ্দ, বিদেশ ট্যুরে অগুণতি খরচ, আমলাদের গাড়ি কেনা বাবদ বরাদ্দ নিয়েও তেমন শব্দ হয়নি।১৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বেড়েছে। গাড়ি কেনার টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। নানা অর্ঘ্যের সঙ্গে মহার্ঘ্য ভাতা বেড়েছে। এমন লুটপাট-হরিলুটের নিরাপত্তায় কড়া আইন হয়েছে। গণমাধ্যম এ নিয়ে বেশি বাড়লে খবর আছে। কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত হাত করতে গেলে জেল জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধানই রাখা হয়েছে।বিষয়টা কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের সক্ষমতা- অক্ষমতার বিষয় নয়। দাতা-গ্রহীতার উভয়ের নৈতিকতার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত।
মাত্র মাস ক’দিন আগে ত্রিপুরার মানিক সরকারের ব্যক্তিগত সততার খবর জেনেছি। তিনি অতি সাধারনভাবে চলতেন। পোশাক-আশাক, চলন-বলনেও তাই। তিনি সরকারি গাড়িও তেমন ব্যবহার করেননি। পরিবারকেও ব্যবহার করতে দিতেন না। জনগণের টাকা হিসাব করে খরচ করতেন। আমাদের মানিকরা শুধু মানিক নন। রতনও। আমাদের আইন করতে হয় জনগণের টাকা দিয়ে এই রতনদের সেবা নিশ্চিত করতে। তফাৎ রাজনীতির সঙ্গে নৈতিকতায়ও।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম