রক্তাক্ত পথ কাম্য নয়
‘রাজধানীতে হাত বাড়ালেই ইয়াবা’ – এমন একটি শিরোনাম দেখেছিলাম কোন এক গণমাধ্যমে। তখনও এখনকার মত কোন অভিযান শুরু হয়নি। এখন ঘোষণা দিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী৷ এই অভিযানের অগ্রভাগে রয়েছে ব়্যাব। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামের এই অভিযানে গত এক সপ্তাহে প্রায় ৫০ জন মাদক ব্যবসায়ী কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
শুধু ইয়াবা নয়, আছে আরও নানা ধরনের ভয়ংকর সব মাদক। তবে এখন বাংলাদেশে মাদকসেবীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই ইয়াবা সেবনকারী। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী। আসক্তদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। এবং মাদকের থাবা সম্প্রসারিত হয়েছে সারা দেশে।
মাদক নির্মূলের পদ্ধতি আর সময় দুটো নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ার নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছরে হঠাৎ করে কেন এই মাদক বিরোধী যুদ্ধ? গত দশ বছরে বলতে গেলে কোন পদক্ষেপই কেন নেয়া হল না? তবে কি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে এই অভিযানের?
রাষ্ট্র কারও জীবন নিয়ে নিতে পারেনা, এমন এক মৌলিক প্রশ্ন করেছেন মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামালসহ অনেকেই। আবার যেসব এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে, সেখানকার মানুষজন উল্লাসও প্রকাশ করছে। কারণ স্থানীয়রা মনে করছে মাদকের কারবারিরা মানুষের জীবন হরণ করছে।
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধও আসলে বিতর্কের উপরে চলে যেত যদি দেশব্যাপী পরিচিত দু’একজন মাদক ব্যক্তিত্বকে দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হতো। তবে তা হয়নি বলে, মাদক নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থাকবে না এমনটা কেউ বলছেন না। সরকার তথা সরকার প্রধানের মাদক বিরোধী অঙ্গীকারকে ইতিবাচকভাবে দেখা যায় যদি তা সঠিক পথে চলে।
কিন্তু প্রশ্ন সেই পদ্ধতি নিয়ে। বিচার না করে রাষ্ট্র কি জীবন নিয়ে নিতে পারে? যেকোন সচেতন মানুষই বলবে পারেনা। প্রায় সকলেই যা বলছেন, তাহলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ অভিযান এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জনগণকে সচেতন করে মাদক নিয়স্ত্রণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত যারা মারা গেছে বা মতান্তরে মারা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই মূলত বাহক। দু’একটি ঘটনা এমনও ঘটেছে যে, নিরীহ কেউ মারা গেছে বা আইনশৃংখলা বাহিনীর দাবি পূরণ করতে না পেরে মারা গেছে।
একজনের কথা জানা গেল নামের বিভ্রাটে মারা গেছে। এবং এই পদ্ধতির ভয়টা এখানেই। কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পথ না খুঁজলে বড় ভুল হতে পারে বলে আশংকা আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন, তার সরকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি জীবন হরণের কথা কি বলেছেন? আমরা অনেক সময়ই জটিল সমস্যাগুলির তাৎক্ষণিক, বা ‘ফটাফট’ সমাধান করতে চাই। কিন্তু অনেক সময়ই এসব কান্ড আসলে সমস্যাকে আরও জটিল করে কার্যক্ষেত্রে বিপরীত ফলদায়ী হয়। এ ক্ষেত্রেও আমার কাছে তা মনে হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব, পদ্ধতিগত ভুল রাজনৈতিক দলগুলিকে এবং তাদের নেতৃত্বকে বিপাকে ফেলে দেয়।
মাদকের ব্যাপকতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, সংশয় নেই। দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মাদকসেবী রয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকে। সেই হিসেবে মাসে প্রায় ৬’শ কোটি টাকা মাদকে ব্যয় হয়। অন্যদিকে দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে দু’শো কোটি টাকার মাদক কেনা-বেচা করে। দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করা, হত্যা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যে মাদকাসক্তির ভূমিকাই বড়।
অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশকে পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে মাদকাসক্তি চোরাচালানের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। প্রধানত মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল থাইল্যান্ড, লাওস, বার্মা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ভারত ও নেপাল সীমান্তের বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশি।
এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ও ব্যাপক ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সংস্থার কার্যাবলী ও তাদের সন্দেহের বাইরে রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা সুযোগকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ হেরোইনের ব্যাপক চালান আসত বার্মা ও থাইল্যান্ড থেকে। ইয়াবা এবং ফেন্সিডিল, দুটোই আসে সীমান্তের ওপার মিয়ানমার ও ভারত থেকে। আমাদের সরকার বা রাষ্ট্র এই দুটি দেশের সরকারের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য।
কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যাবে তা নিয়ে সৃজনশীল ভাবনা প্রয়োজন। যদি চাহিদা থাকে, তবে সরবরাহ আসবেই। তাই এর সহজলভ্যতা বন্ধ করে দিতে হবে। আর এজন্য সীমান্তে কড়াকড়ি প্রয়োজন। মাদক ব্যবসার অভিয়োগ আছে জনপ্রতিনিধি, মাদক নিয়ন্ত্রোণ অধিদপ্তরের কর্মী ও আইনশৃখলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও। বিপুল বেকারত্বও তারুণ্যকে হতাশায় ডুবিয়ে মাদকের দিকে নিয়ে যায়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিত্তশালীদের সন্তানদের কেবল জঙ্গি করছেনা, মাদকাসক্তও করছে।
মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। নিশ্চয়ই, রাষ্ট্রের চেয়ে মাদক সিন্ডিকেট শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমতে বাধ্য। কিন্তু বন্ধুকের নল সমাধানের পথ নয়। এই সিদ্ধান্ত ফলদায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেই বন্দুকের শাসনে অনেক সাধারণ মানুষ অশেষ লাঞ্ছনার শিকার হয়। কিন্তু তাই বলে বন্দুক পুরোপুরি উঠিয়েও নেয়া যাবেনা। কারণ সে ক্ষেত্রে মাদকের কারবারিরা তাদের শাসন অনিবার্য করে ফেলবে, ফলে জনতার দুর্গতিও অব্যাহত থাকবে। বন্দুকের নির্বিচার নয়, যৌক্তিক প্রয়োগ চায় মানুষ।
মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশ্ন। অনিবার্য ভাবে মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর যেমন হবে, তেমনি মাদকাসক্তদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগও জোরদার করতে হবে। কিন্তু বেশি যা লাগবে তাহলো জাতীয় জাগরণ। প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য দেশের সবাইকে যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম