মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি ক্রোক করা হোক
আমরা সবাই কি জানি, মাকড়সার কোমর সরু কেন? মনে হয় না। ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা পুরোপুরি মনে নেই। তবে মোটের উপর অনেকটা এ রকম, এক মাকড়সার ছয়টি ছেলে ছিল। তো একদিন সেই মাকড়সা এক বাড়িতে ভোজের নিমন্ত্রণ পেল। কিছুক্ষণের মধ্যে একই দিনে তার আরও পাঁচ বাড়িতে ভোজের নিমন্ত্রণ এলো।
মাকড়সাটি ছিল ভীষণ ভোজনরসিক। সে ভোজের নিমন্ত্রণ কখনওই মিস করতে চায় না। কি করবে? অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলো, ছয় ছেলেকে ছয় বাড়িতে পাঠাবে। এবং নিজের কোমরে একটা দড়ি বেঁধে নিবে। যে বাড়িতে যখন ভোজ শুরু হবে, সেই বাড়িতে উপস্থিত ছেলে দড়ি ধরে টান দেবে। তাতে মাকড়সা বুঝবে অনুষ্ঠানে ভোজ শুরু হয়েছে এবং সে সময়মত অনুষ্ঠানে চলে যাবে।
ছেলেরা চলে গেছে পরিকল্পনা মত। রেডি হয়ে মাকড়সা বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে, কোন দিকের দড়ি আগে টান পড়ে। অপেক্ষা করছে, কোনও দিকের দড়ি-ই- টান পড়ছে না। হঠাৎ অনুভব করলো একটা দড়িতে টান পড়েছে। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। পা বাড়িয়েছে অমনি পরপর বাকি পাঁচ দড়িতে পাঁচ দিক দিয়ে টান পড়ল। মাকড়সা আর নড়তে পারে না। এক সঙ্গে ছয় দিকের ছয় দড়ির টানে তার কোমর সেই যে সরু হলো, আজও সেই সরু-ই আছে। হ্যাঁ, প্রাণীবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে বলতে পারি এগুলো নেহাত গল্প।
অফিস, বাসা এবং সংগঠনের ত্রিমুখী চাপে আমাকে প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক এবং সামাজিক কিছু কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে যে, অবস্থা অনেকটা বেচারা মাকড়সার মত। ভাল করে খবরের কাগজও পড়া হয়ে উঠছে না। তবে কাজের প্রয়োজনে যতটা দেখা দরকার ততটা দেখছি ঠিকই।
এরই মধ্যে কিছুদিন আগে চোখে পড়ল কোন এক বাস হেলপার কোটিপতি হয়ে গেছে। খুবই ভাল কথা। ব্যক্তির সমৃদ্ধি থেকেই দেশের সমৃদ্ধি আসে। জাতি সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। না হলে তো আমরা ডিজিটাল, উন্নয়নশীল দেশ এগুলো উৎযাপন করতে পারতাম না।
কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। লোকটি কোটিপতি হয়েছে অবৈধ উপায়ে, মাদক ব্যবসার মাধ্যমে। বাড়ি, গাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবই রয়েছে তার। তাও মাত্র কয়েক বছরে। মনে হতে পারে, আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। অথচ তাও নয়, এ অন্য আশ্চর্য, যার নাম ইয়াবা।
পুঁজিবাদের এখন যে বিকশিত রূপ তা হলো কনজিউমারিজম। সব কিছুই এখন পণ্য। মানুষও এখন পণ্য। এমনিতেই এখন ছেলেমেয়েরা শুধু জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য পড়ে। নৈতিকতা শেখাতো দূরের কথা বরং গণিতে শেখে ৫ লিটার দুধের সাথে ২ লিটার পানি মেশালে দুধওয়ালার কত লাভ হবে?
বড়লোক আর ধনী যে, সমার্থক নয় এটা অনেকে ভুলেই গেছেন। পুঁজিবাদী শিক্ষা এই প্রজন্মকে আত্মকেন্ত্রিক, সেলফ সেন্টারড করছে। সাথে বোঝার আগেই হাতে আছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। ইন্টারনেট। সার্চ দিলেই ইনফরমেশন, মিস ইনফরমেশন, রং ইনফরমেশন সবই চলে আসে। তবে মিস আর রং ইনফরমেশন একটু বেশি সুন্দরভাবে আসে। আকর্ষণীয়ভাবে আসে। চারপাশে শুধু কেনার প্রতিযোগিতা। ধনীরা ফ্যাশন তৈরি করছে কেনার আসক্তি বাড়ানোর জন্যে আর গরিব যেকোন ভাবে টাকা আয় করে সেই পণ্য কিনছে জাতে ওঠার জন্য। এতে ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। কারণ গরিবের টাকা ঘুরেফিরে আবার ধনীর হাতেই চলে যাচ্ছে।
এটাই নৈতিকতা বিবর্জিত আধুনিক শিক্ষার সুফল। খুব শ্রুতিকটু আরও একটি বিষয় দেখি- ভয়হীন, অনর্গল মিথ্যে বলা। কোন সুশিক্ষিত মানুষ কখনই অনর্গল মিথ্যা বলতে পারে না। অবশ্যই আর রুচিতে বাঁধবে। কারণ এটা অনৈতিক। যে মিথ্যা বলতে পারে সে যেকোন ধরনের পাপ করতে পারবে।
এখন এই ধরনের অনৈতিক উপার্জনকারীরা যদি আ-পথে, কু-পথে সম্পদশালী হয় এবং তাকে শোধরানোর কোন ব্যবস্থা রাষ্ট্র না নেয় তবে তো তরুণ প্রজন্ম আ-পথে, কু-পথে অর্থ উপার্জনে আকৃষ্ট হবেই। শুধু মাদক বাণিজ্য আর নেটওয়ার্ক মেইনটেইনের কারণে এখন অনেক রাজনীতিক, অরাজনীতিক লোকজন সহসা কোটিপতি।
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশের যে কোন মানুষ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করলে তার সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্র ক্রোক করতে হবে এবং তা রাষ্ট্রের হয়ে যাবে। রাষ্ট্র সেই সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করবে। এতে করে এই ধরনের ব্যক্তিদের পরিবারও তাদের এসব কাজে সহযোগিতা করবে না। যেহেতু এই অবৈধ সম্পত্তি তারা ভোগ করতে পারবে না।
তবে রাষ্ট্র ও আইন যত কঠোর হোক, কঠিন হোক, নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। নৈতিক শিক্ষাই মানুষের ভেতর বোধ জাগ্রত করে। বিবেক তৈরি করে। আর মনে রাখতে হবে, নৈতিকতা আছে বলেই এখনও জগত টিকে আছে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর