আমাদের বামেরা
সদ্যসমাপ্ত খুলনা সিটি নির্বাচনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বামদল সিপিবি’র মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু (কাস্তে) ৫৩৪ ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনের অনেক হিসাবের মাঝে এই অংক কেন উঠে এলো তা এক প্রশ্ন বটে। সিপিবি এই কয়টি ভোট পায়? এবং নির্বাচন একেবারে পশ্চিমা ধাঁচের স্বচ্ছ হলে কয়টি ভোট বাড়তো? এসব প্রশ্ন সর্বত্র।
প্রশ্ন এ কারণে যে সিপিবি ও এদেশের বামেরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র বাইরে গিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হতে চায়। এটি এক উত্তম ভাবনা এবং সত্যি সত্যি কাঙ্ক্ষিত ভাবনা। কিন্তু খুলনায় এমন একটি অংকে পৌঁছানোর পর প্রশ্ন সিপিবি ও বামেরা আসলে কী করবে- তারা কি গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই করবে? নাকি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করবে? আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে সিপিবি এমন একটি ফলাফল করার পর তাতে কেউ যদি এমন ব্যাখ্যা করেন তবে কি তা অন্যায় হবে? রাজনৈতিক দলের প্রতাপ থাকে, জনভিত্তি থাকে। বোঝাই গেল এই দলের বা এ ধরনের দলগুলোর জনভিত্তি আজ তলানিতে।
‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি জনগণের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য লড়াই। নিজেদের ভেতরকার অনৈক্য দূর করে এই লড়াইয়ে নামলে হয়তো জনগণ নামবে তাদের সাথে।’
তবে একথাও সত্য যে কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হোক তার বিদ্ধ করবার ক্ষমতা থাকে। সিপিবিও তা-ই করার চেষ্টা করেছে। ভোটের চিত্র নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছে তার প্রার্থী, সেকথা আবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আবিষ্কৃত সামাজিক মাধ্যমে বেশ বড় করেই শেয়ার করছেন দলের নেতারা। তারা সরকারকে কণ্টক বিদ্ধ করতে চাচ্ছেন, কিন্তু বিষকাঁটার জ্বালা নিজেরাও ভোগ করছে কিনা জানতে পারছি না।
বামদলগুলোর বেশ সংকটকাল চলছে। এই সংকটের মুহূর্তেই প্রয়োজন হয় আত্মসমীক্ষা। কমিউনিস্ট আন্দোলন যে এদেশে শিকড় গাড়তে পারেনি তার একটা প্রধান কারণ হলো তারা তাদের পরিচিতিটাই জনগণের কাছে নিতে পারেনি। এরা বরাবরই আধুনিকতায় বিশ্বাসী। এরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেনি। এসবই সত্যি। কিন্তু এও সত্যি এসবই শুধু প্রভাব ফেলেছে শহুরে মধ্যবিত্তের মাঝে।
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিন্তা, সরকারি কাজকর্ম কী উপায়ে ঠিকভাবে, ভালো করে চলতে পারে, এবং দেশে যারা কোনো রকম অর্থনৈতিক প্রগতির সুযোগ পান না, কীভাবে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের প্রসার করা যেতে পারে, কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে, আসে। এগুলো মানুষের প্রাণের দাবি। তবুও বামপন্থীরা কেন এত দুর্বল?, কেন এমনটা ভোট পায়? সেই আলোচনা, সেই বিশ্লেষণ তারা করবেন আশা করি।
এদেশে একটা দীর্ঘসময় বাম রাজনীতির নেতৃত্ব উচ্চশ্রেণির হাতে সীমিত ছিল। এরা বাম দর্শনের আমূল বাস্তবায়ন করতে পারেনি নিজেদের শ্রেণিগত সীমার কারণেই। এবং হয়তো সেটাই হলো এখনকার দুর্বলতার বড় কারণ। বাম রাজনীতিতে এখনো মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের প্রভাবটা বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের কথা উচ্চারণে, বৈষম্যের জবাব দেয়ায় বামেদের দুর্বলতাই নির্দেশ করে এমন ফলাফল।
এদেশের বামেদের চিন্তাজগতে একসময় বিদেশ থেকে আসা ভাবাদর্শ বেশি মাত্রায় ছিল। অনেক ধরনের পন্থী বিরোধে অনেক শক্তি ক্ষয় করেছে তারা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বলে একটা বস্তু স্থির করে দীর্ঘ সময় এদেশের বামেরা সংশোধনবাদী আর সম্প্রসারণবাদী বলে নিজেদের সাথেই লড়াই করেছে। বাম হঠকারীতার সাথে বরাবরই বাস্তবতার ছিল বড় রকমের ফারাক। সেই ফারাক এখনো পূরণ করা যায়নি।
বাজার অর্থনীতির যে আগ্রাসী তত্ত্ব মেনে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলেছে তার জবাবে নতুন চিন্তার আশা করে মানুষ এই বামেদের কাছে। অর্থনৈতিক বাস্তব নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা দরকার। বাজারব্যবস্থার প্রয়োগে লোকের অর্থনৈতিক উন্নতি কতটা করা সম্ভব, এটা একটা বড় প্রশ্ন। বাজার দর্শনের এই আগ্রাসী তৎপরতার বিপরীতে গ্রহণযোগ্য তৎপরতা নেই বামেদের।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি জনগণের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য লড়াই। নিজেদের ভেতরকার অনৈক্য দূর করে এই লড়াইয়ে নামলে হয়তো জনগণ নামবে তাদের সাথে। জমির অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার, নারী অধিকারের আন্দোলন থেকে অনেক সময়ই নিজেদের দূরে রাখে। কিন্তু এসব আন্দোলনই হতে পারে মানুষের নৈকট্য পাওয়ার বড় পথ। চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে বের হতে না পারলে কণ্ঠ ক্ষীণ হতে বাধ্য।
গরিব এবং বড়লোক, অবস্থাপন্ন এবং অবস্থাহীন, ক্ষমতাশীল এবং ক্ষমতাহীন, এমন ধারায় বিভক্ত সমাজে বামপন্থীদের কাছ থেকে আমরা যা আশা করি তা পাওয়া যায় না। পাওয়া না গেলে কী করে হবে তারা তৃতীয় শক্তি?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/বিএ/এমএস