মাহাথিরের বিজয় ও প্রবাসীদের জয়োল্লাস
রাজনৈতিক অবসর ভেঙে ড. মাহাথির মোহাম্মদ আবারও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। সহস্র অভিনন্দন মাহাথিরকে তাঁর এই চমক লাগানো বিজয়ের জন্য। এটি মালয়েশিয়ার ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। অভূতপূর্ব এই জন্য যে ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মালয়েশিয়া বার বার ক্ষমতায় ছিলেন আমনো'র (UMNO) নেতৃত্বে বারিসান ন্যাশনাল (BN) জোট।
বিগত দিনে প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনেই বিএন জয়ী হয়েছে; এবং তারাই ক্ষমতাসীন ছিল। এই আমনো'র নেতৃত্বে বিএন জোটের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কয়েক মেয়াদে ড. মাহাথির মোহাম্মদ টানা বাইশ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর শাসনের সেই বাইশ বছরেই পাহাড়-বন-জঙ্গলের দেশ মালয়েশিয়া আধুনিক মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিতি পায় বিশ্বে। ব্যাপক উন্নতি লাভ করে মালয়েশিয়া।
বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ টু-ইন টাওয়ার 'পেট্রুনাস টু ইন টাওয়ার' নির্মাণ করেছিলেন তিনি-ই।' পেট্রুনাস টু ইন টাওয়ার' নির্মাণ নিয়ে সাহসী মজার একটি কাহিনী শুনেছিলাম মালয়েশিয়ানদের কাছে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে মাহাথির যখন ব্যয়বহুল 'পেট্রুনাস টু ইন টাওয়ার' নির্মাণের ঘোষণা দিলেন, তখন বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছিল এত ব্যয়বহুল ভবন নির্মাণ করা সম্ভব কিনা। মালয়েশিয়ার সরকারের আর্থিক সামর্থ্য আছে কিনা। তখন মাহাথির বলেছিলেন, 'মালয়েশিয়া বোলে'। এই শব্দের অর্থ হচ্ছে 'মালয়েশিয়া পারবে বা পারে' (Malaysia can)।
ঠিকই মাহাথির পেরে দেখিয়েছিলেন মালয়েশিয়াকে; শুধু মালয়েশিয়াকে নয়, পুরো বিশ্বকেই তিনি নিজ দেশের উন্নতি করে দেখিয়েছিলেন। সেই থেকে মালয়েশিয়ার মানুষের মুখে মুখে একটি বাক্য ছিল, 'মালয়েশিয়া বোলে'। ২০০৩ সালের অক্টোবরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ও দলের সভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তিনি অবসর নিয়েছিলেন পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে। তাঁর দেশকে এশিয়ার ইউরোপ বানিয়ে; মালয়েশিয়াকে বিশ্ববাসীর আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র বানিয়ে।
২০০৩ সালে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে ছিলেন তাঁর তখনকার ডিপুটি আব্দুল্লাহ আহমদ বাদাবির কাছে। ২০০৯ এ এসে বাদাবি ক্ষমতা ছেড়ে ছিলেন তাঁর ডিপুটি নাজিব রাজ্জাকের কাছে। যিনি গত ৯ মে ১৪ তম জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেলেন। এই পরাজয়ের মাধ্যমে দেশটির স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার ক্ষমতার বাইরে গেলো umno তথা বারিসান ন্যাশনাল জোট।
২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রীত্ব ও দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেও মাহাথির দলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে দেশটির রাষ্ট্রীয় পেট্রোলিয়াম কোম্পানি 'পেট্রুনাস'র উপদেষ্টা ছিলেন। মালয়েশিয়ান অটোমোবাইল কোম্পানি 'প্রোটন' এর উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি।
রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েও এই দুই পদে থেকে দেশের সেবা করেছিলেন মাহাথির। পাশাপাশি তাঁর ছেলে মুখরিজ মাহাথির নাজিবের সাথে আমনো'র রাজনীতি করতে থাকেন। এবং মুখরিখ কেডাহ প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন।
২০১৪/২০১৫ সাল থেকে নাজিবের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন মাহাথির। ২০১৫ সালে নাজিবের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলনে যোগ দিয়ে নাজিবের পদত্যাগ দাবি করেন মাহাথির। তখনও তিনি ও তাঁর ছেলে আমনো'র সাথেই ছিলেন। পরে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে মাহাথির ও তাঁর ছেলে দল ছাড়েন।
২০১৬ সালের মার্চে তিনি পেট্রুনাস ও প্রোটন উপদেষ্টার পদও ছাড়েন তিনি। সেই বছরই তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর সাথে ছিলেন নাজিবের সাবেক ডিপুটি প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াছিন, সাবেক মন্ত্রী শফি আফদাল ও মাহাথির পুত্র মুখরিজ সহ নাজিবের দল ছেড়ে আসা অনেক নেতাকর্মী।
দল গঠনের পর পর প্রধান প্রধান বিরোধী দল গুলো নিয়ে জোট গঠন করে ১৪ তম জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর জোটে আছে তাঁর এক সময়ের ডিপুটি কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের দলও। নতুন দল ও জোট গঠনের পর থেকে রাজনীতিতে দ্বিতীয় বারের মত সক্রিয় হন বয়স নব্বই পেরোনো মাহাথির। সাথে আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ও মেয়ে নুরুল ইজ্জা।
যে বলা, সেই কাজ! বুধবার (৯মে) ১৪ তম নির্বাচনে জয়ী হয় মাহাথিরের নেতৃত্বে পাকাতান হারাপান জোট। আবারও প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রায় ১৫ বছর আগে অবসর নেওয়া মাহাথির। ফিরে এলেন দেশ সেবায়। তিনি পুনর্গঠন করতে চান মালয়েশিয়ার অর্থনীতি।
মাহাথির বাংলাদেশিদের খুব পছন্দের একজন ব্যক্তিত্ব। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক হওয়ার পর বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাহাথিরকে পেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা খুব কাছে গিয়ে কথা বলেছেন, ছবি তুলেছেন। মাহাথির পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী অসংখ্য বাংলাদেশি ফেসবুকে মাহাথিরের সাথে তোলা হাসিমুখের ছবি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন মাহাথিরকে। মাহাথিরের আন্তরিকতায় বাংলাদেশে (চট্টগ্রামে) মালয়েশিয়ান প্রোটন গাড়ি তৈরি হচ্ছে।
মাহাথিরের মেয়ে মেরিনা মাহাথিরও সম্পৃক্ত আছেন চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন'র সাথে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরকালীন হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতে শেখ হাসিনার সাথে আন্তরিকতার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন মাহাথির। মাহাথিরের নতুন সরকারের সাথে বাংলাদেশের বিদ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো সমৃদ্ধ হবে আশা করি। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই ড. মাহাথির মোহাম্মদকে।
লেখক : মালয়েশিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম