ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আলহামদুলিল্লাহ এখনও বেঁচে আছি!

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ০৯ মে ২০১৮

রাস্তা পার হচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই ফাঁকা রাস্তায় কোথা থেকে যেন একটি বাস এসে থেমে গেলো। রাস্তা পার হওয়া মানে আমার কাছে আরেক বিভীষিকার নাম। ভীতু আমি এমনিতে একা চলতে গেলে খুব সমস্যায় পড়ি রাস্তা পারাপার নিয়ে। তাই চেষ্টা করি ফাঁকা রাস্তা ধরেই চলতে। কিন্তু কোন সিগন্যাল ছাড়াই যখন বাসগুলো উল্টো রাস্তা ধরে এসে সামনে পড়ে তখন জীবনের আশঙ্কা করা যেন ফরজ হয়ে যায়।

আছে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো ও নামানোর প্রতিযোগিতা। মাঝেমাঝে আবার বাসগুলো নিজেদের মধ্যে কে কার আগে যেতে পারে সেটি নিয়েও প্রতিযোগিতায় নামে। ব্যস্ত এই ঢাকা শহরের রাস্তায় যেখানে মানুষের হাঁটার জায়গা থাকে না সেখানে যখন যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে তখন বাসের ভিতরের ও বাইরের যাত্রী বা পথচারীদের অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কী বা করার থাকে !

ভাঙ্গাচোড়া বাসগুলোর বেশিরভাগেরই লুকিং গ্লাস থাকে না। জানালা থাকে না। বাসের হেলপার যাদের রাখা হয় তাদেরও বেশিরভাগেরই বয়স অনেক কম। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এই ক্ষেত্রে যেন কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। দরিদ্র পরিবারের বাবা মা কতটা কষ্টের মধ্যে তাদের আদরের ধনকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেন সেটিও চিন্তা করার বিষয়।

এমন বাচ্চাদের না আছে ট্রাফিক আইনের জ্ঞান না আছে জীবনের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা। তারা অনেকটাই ড্রাইভারের নির্দেশেই চলে। ড্রাইভারদেরকেও মাঝে মাঝে দেখা যায় কন্ডাক্টরের ভূমিকা পালন করতে। তারা ড্রাইভিং সিটে বসেই যাত্রীদের ভাড়া নিচ্ছে আবার হেলপারকেও নির্দেশনা দিচ্ছে ।

বাংলাদেশ। এই নামটা উচ্চারণের মাঝে আমি খুঁজে পাই এক অসামান্য তৃপ্তি। পাই বুক ভরে শ্বাস নেবার প্রেরণা। এই একটা নামের মাঝেই যেন লুকিয়ে আছে আমার সকল পরিচয়। ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে এগিয়ে চলা এই দেশটিতে আমি জন্ম নিয়েছি ভেবেই নিজের মনে মনে গর্ব করি। এখনও আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালোবাসি বলার মাঝে যে সুখ পাই তেমনটি আর কিছুতেই আসে না। জাতীয় সঙ্গীত শুনলে এখনও চোখের জল গড়িয়ে পড়ে নিজেই।

সবকিছুই অপরিবর্তিত আছে। হ্যাঁ, আমরা নাগরিকরা ঠিক আগের জায়গাতেই আছি। একটুও পরিবর্তন হয়নি দেশের প্রতি মমতার জায়গাটি। কিন্ত কেন জানিনা এই দেশ, এই রাষ্ট্র আমাদের এই ভালোবাসার, এই মমত্ববোধের, এই নিঃশর্ত প্রেমের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে। প্রতি মুহূর্তে আঘাত দিয়েই যাচ্ছে।

প্রতিদিনের সংবাদ্গুলো আমাদেরকে শঙ্কিত করে তুলছে। দেশের উপর, রাষ্ট্রের উপর ভরসার জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে। শত ভাগে বিভক্ত রাজনৈতিক মতের এই দেশে এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া এই দেশটির জন্মের পিছনে যে স্বপ্ন ছিলো সেই স্বপ্ন আজ আঘাতে আঘাতে একপ্রকার পঙ্গু হিসেবেই বেঁচে আছে। এ যেন দেহ আছে কিন্তু প্রাণটি মরে যাওয়া গাছের মত কেবল দাঁড়িয়ে থেকে অস্তিত্বটুকু জানান দিয়ে যাচ্ছে।

খুব বেশি কী চায় এই দেশের মানুষেরা? না। খুব বেশি উচ্চাকাঙ্খা নেই আমাদের। কেবল একটি সভ্য দেশের নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই আমরা। সড়কে নেমে সুস্থ ও সুন্দরভাবে চলাফেরা করতে চাই। নদীপথে, আকাশপথে একটু নিরাপদ যাতায়াতের নিশ্চয়তা চাই। কর্মক্ষমের জন্য বেঁচে থাকার মত একটি উপার্জনের রাস্তা চাই।

কয়দিন পরপর একেকধরনের সমস্যা এসে আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে তছনছ করে দিয়ে যায়। একটা সমস্যার প্রকটতায় আরেকটা চাপা পড়ে যায়। ভুলে যাই, যেতে হয়। কিন্তু সমস্যাগুলো কী মিটে যায়? নাকি একটি সমস্যার ব্যাপকতার কাছে আরেকটি সমস্যা হার মেনে পিছে দাঁড়িয়ে থাকে সঠিক সময়ে আবার সামনে আসার জন্য?

ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ছিলো আছে এবং বেড়েই চলেছে। শত শত সমস্যাকে যখন আমরা এই নাগরিকেরাই মোকাবিলা করে একটু বেঁচে থাকতে চাইছি তখন নতুন আপদের নাম হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। অবশ্য এটি ছিলনাই বা কবে? কত প্রাণ নিয়ে গেলো অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা। সড়কে নেমে প্রাণ দিচ্ছে প্রতিদিন। ঈদে পার্বণে লঞ্চে ডুবে প্রাণ দিচ্ছে মানুষ। গত কিছুদিন ধরে চলছে রাস্তায় নেমে হাত পা হারিয়ে হাসপাতালের বিছানায় জীবন দেয়ার মত ঘটনা।

পরিবারের একমাত্র অবলম্বন কলেজছাত্র রাজীবের ঘটনায় যখন সারাদেশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ঠিক তখনি খবর এলো রোজিনা নামের এক মেয়ে তার পা হারিয়েছে রাস্তা পার হতে গিয়ে। জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় কাজ করতে এসে রোজিনা শিকার হয়েছে ঘাতক বাসের। রাস্তা পার হবার পথে ডাবল ডেকার বাস কেবল তাকে ধাক্কাই দিয়ে যাইনি, পায়ের উপর বাস চালিয়ে দিয়ে চিরতরে নিভিয়ে দিয়ে গেছে মেয়েটির প্রাণপ্রদীপ।

অবশেষে রোজিনা নামের মেয়েটি জীবন যন্ত্রণার সাথে লড়াইয়ে না পেরে এই পৃথীবীকে ত্যাগ করেছে। অথচ কতইবা বয়স মেয়েটির। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলো ঢাকায় কাজ করতে। ফুটফুটে চেহারার মেয়েটিও এদেশের নাগরিক। আর্থিক অসচ্ছলতা যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের জন্য এমন একটি ঘটনা মরার উপর খাড়ার ঘা হয়েই আসে। চিকিৎসার খরচ টানা হয়ে যায় প্রায় অসম্ভব।

এমন ঘটনার তালিকা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। আলোচনা সমালোচনা সবই চলছে। থেমে নেই কিছুই কিন্তু প্রকৃত অর্থে যে পদক্ষেপ নেয়ার দরকার অভাব কেবল সে জায়গাটির। সরকারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে কোন উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার বিন্দুমাত্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। নাগরিক সুবিধার এই মৌলিক চাহিদাটি পূরণে কোথায় সমস্যা সে জায়গাও ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি যাত্রীদের অসচেতনতার কথা বলেছেন। আমরা বুঝি তিনি এটিকেই একমাত্র কারণ বলতে চান নি হয়তো। কিন্তু প্রতিদিন যখন একই রকম ঘটনা ঘটে চলেছে তখন কী কেবল নাগরিকের অসচেতন চলাফেরাকেই দায়ী করে বসে থাকার উপায় আছে?

যাত্রীদের অসচেতনতার বিষয়টি উপেক্ষা করার উপায় নেই। আমরা নাগরিকেরাও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চাই না, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে আছে অনীহা। ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলতেও অনেক সময়েই আমাদের অজ্ঞানতা প্রকাশ পায়। এসব বিষয়কে মোটেও অস্বীকার করার জায়গা নেই। পাশাপাশি, পাবলিক বাসের ড্রাইভারদের বিষয়েও কি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি নয়? ড্রাইভার নির্বাচনের ক্রাইটেরিয়া কী? তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। একজন ড্রাইভার দিনে কয় ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারে এবং বাস্তবে কত ঘন্টা চালায়? লাইসেন্সিং এর নিয়ম কী? এমন অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া এইমুহূর্তের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কি কারও আছে না থাকতে পারে? রাস্তায় যেসব বাসগুলো চলছে সেগুলোর চেহারা দেখলেই বুঝা যায় কতটা অবহেলায় বেঁচে আছে এই বিশাল সেক্টরটি। পরিবহন খাতের এই অরাজকতা বলে শেষ করা যাবে না। এর সম্পর্কে কি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওয়াকিবহাল নয়? আসলেই কী তারা অজ্ঞান? নাকি জেনেবুঝেই এই অবস্থাকে লালন করে যাচ্ছে দিনের পর দিন?

আর কত মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা বুঝতে শিখবো বা অনুধাবন করবো যে সামান্য অবহেলায় একজন মানুষের মৃত্যুও একটি খুনের সমান। আর কত রাজিব, রোজিনাদেরকে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হবে আমাদের অব্যবস্থাপনার কাছে? জানিনা। সত্যি জানি না এর উত্তর কে দিবে, কখন দিবে? প্রতিকারই বা কার কাছে চাইবো? কেউ কী আছেন আমাদের এই আর্তনাদকে মূল্য দেবার?

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন