ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ছাত্ররাজনীতি হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ০৫ মে ২০১৮

 

ছাত্ররাজনীতি থাকুক, তবে তা হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন হয়ে গেল। এ মাসেই হবে কেন্দ্রীয় সম্মেলন। অনেকেরই দৃষ্টি আছে কেমন কমিটি হয় এবার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোনো ধরনের সিন্ডিকেট দিয়ে ছাত্রলীগ চলবেনা। দলের জন্য ত্যাগী ও যোগ্যরাই নেতৃত্বে আসবেন। এর বাইরে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগকে সাজানো হবে নতুন মডেলে।

এসব আশা জাগানীয়া কথা ঠিকই, তবে সত্যিকারভাবে আশা জাগায়না। কারণ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ছাত্রলীগের এখন আর যোগাযোগ নেই। যেটুকু আছে, তাহলো ক্ষমতার প্রভাব। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে তাই বলে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের ছায়াতলে চলে গেছে, সেকথাও বলা যাচ্ছেনা। ছাত্র রাজনীতি আজ কেমন যেন অবাঞ্ছিত হয়ে উঠেছে।

আমরা জানি ছাত্র রাজনীতির একটা স্বর্ণালী সময় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, থেকে শুরু করে বেঁচে আছেন এমন অনেক কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক, এমনকি প্রশাসকও ছাত্র রাজনীতি থেকে এসেছেন। দেশে এই মুহূর্তে কোন ছাত্র আন্দোলন নেই, ফলে গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি নেই। হারিয়ে যাওয়া ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার ছিল লেখা পড়া, বই খাতা, কাগজ কলম, মেধা আর মানুষের জন্য প্রেম। এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হলো মাদক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শনসহ নানা ধরনের অবৈধ বাণিজ্য। খুব সরলীকরণ মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু তা-ই।

সহিংসতা ঘটছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে, প্রাণ যাচ্ছে, রক্ত ঝরছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন মানেই একাধিক গ্রুপ এবং রক্তারক্তি। এসব সংঘর্ষ আর সহিংসতার ছবি টিভি পর্দায়, কিংবা পত্রিকায় দেখে যেকোন স্বাভাবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের কষ্ট লাগে। ফলে ছাত্ররাজনীতি নিয়েই এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে। ছাত্র রাজনীতি আছে, তার নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আছে। কিন্তু দেশে দীর্ঘ সময় কোন ছাত্র আন্দোলন নেই।

ছাত্ররা রাজনীতি করবে না এমনটা বলার অর্থ হলো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, ছাত্র রাজনীতির নামে চলা হিংসার তাণ্ডবে আজ কোন ইতিবাচক ভাবমূর্তি নেই ছাত্ররাজনীতির।

নব্বইয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পর থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না। কথায় কথায় আমরা এদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আনি। কিন্তু ভাবছিনা একবারও এখন আর সেই ছাত্র আন্দোলন নেই। একটা সময় ছিল ছাত্র আন্দোলন ছিল ছাত্রদেরই আন্দোলন। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা প্রান্তিক। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বও ঠিক করা মূল দলের কেন্দ্র থেকে। আর এলাকা দখলের রাজনীতির দাপটে নেতাদের মদদে সেই জায়গা দখল করে রাখছে সশস্ত্র ক্যাডাররা। এই বাস্তবতায় সামগ্রিক ছাত্র আন্দোলনের অবস্থা নিতান্ত করুণ। আগে গুন্ডারা ছাত্রদের সমঝে চলত, এখন ছাত্ররা গুন্ডাদের মেনে চলে।

ছাত্রদের রয়েছে তীব্র আবেগ, তীব্র ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আদর্শনিষ্ঠ চারিত্র্যিক সততা। এবং এ কারণেই আমরা দেখেছি দেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরে সকল গণআন্দোলনে, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এই অপরিণামদর্শী তারুণ্য সব সময় সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছে। কিন্তু সেই ছাত্ররাই নিজেরা নিজেরা, নিজের দলের কর্মীদের পর্যন্ত জীবন কেড়ে নিচ্ছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন দলীয় রাজনীতি করার কারণেই ছাত্ররা দলের ক্রীড়নক হয়ে পড়ছে। কথাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে আঠারো বছর বয়স হলেই যে-কোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। ভোট দেওয়ার অধিকারের পিছনে যে গণতান্ত্রিক যুক্তিটি রয়েছে, তা হল, নির্বাচনী গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আঠারো বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন রাজনীতি করবে প্রশ্ন হলো সেটি। দলের লেজুড়বৃত্তি করে চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসী হবে, নাকি ভবিষ্যতের একজন সুরাজনীতিক হওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতি কররে?

অনেকেই পশ্চিমা দেশের প্রসঙ্গ আনবেন। সত্যি বলতে কি, সেখানকার ছাত্রছাত্রীরাও সক্রিয় রাজনীতি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সে-সব দেশে সবার আছে। শিক্ষা ও সামাজিক ইস্যুতে সেসব দেশে ছাত্র আন্দোলন হয়, সভা, সমাবেশ ও মিছিল হয়। কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতি আজ যে কারণে নিন্দিত, তার কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক দলীয় অনুপ্রবেশ। ছাত্র সংগঠন সমূহের এখন আর কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। বাইরের নেতাদের নির্দেশে বা অপ-নির্দেশে শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা চালিত হচ্ছে।

বাইরের এই নির্দেশ বা অপ-নির্দেশের কারণে এখনকার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রম। যেমন ভর্তি বা সিট বাণিজ্য, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি যার স্বাভাবিক পরিণাম দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি আছে, কিন্তু ছাত্র সংসদ নেই। এর ফলে ছাত্র সংগঠন গুলোর স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছেনা, রাজনৈতিক দল আর বহিরাগত নেতাদের অনুপ্রবেশও বন্ধ করা যাচ্ছেনা। স্বৈরাচারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্রের আমলে তা আর হলোনা।

ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায় নিজেদের প্রতিনিধি চয়ন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলের প্রশাখায় পরিণত হয়ে নিজস্বতা হারিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলির ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। তাই এ দেশে ছাত্র রাজনীতি এক বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসগুলি রাজনৈতিক দলগুলির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে, ছাত্র সংগঠনের নেতা, বিশেষ করে বড় দুটি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা তারাই হয়েছেন, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা জানেন না বা জানতে চান না, যারা শিক্ষার প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।

বরং এদের সাথে বহিরাগতদের যোগাযোগ বেশি, এরা ক্যাম্পাস ভিত্তিক একডেমিক পরিসরের কাজ করার চাইতে, অর্থ উপার্জনে পারদর্শি বেশি। তিনিই ‘ছাত্র নেতা’ বা ‘ছাত্রী নেতা’ যিনি ভাল ভর্তি বাণিজ্য বা সিট বাণিজ্য করেন। তিনিই বড় নেতা যিনি নিজ সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়েও বাণিজ্য করার খ্যাতিলাভ করেছেন। তিনিই বড় নেতা যিনি শিক্ষকদের ভাল হেনস্থা করতে পারেন। এর নাম রাজনীতি নয়, রাজনীতির নামে পরিহাস।

ছাত্র সংগঠনগুলো এমনই পরাজিত যে, তারা যে যে দলের সমর্থনপুষ্ট সেই বড় রাজনৈতিক দলগুলির সমালোচনা করার সাহসও রাখেনা। বড় সামাজিক ইস্যুতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করলে তাতে যোগ দেয় না এরা। উল্টো কখনো কখনো পেটোয়াবাহিনী হিসেবে শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়ে।

ছাত্ররাজনীতি থাকুক, তবে তা হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত, এটি একটি সাধারণ প্রত্যাশা। বিতর্ক হচ্ছে, তা ভাল লক্ষণ। ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি উঠে আসছে। দলীয় প্রভাবমুক্ত ছাত্র রাজনীতি জরুরি। ছাত্র সংগঠনগুলিকে শুধু খাতায়-কলমে রাজনৈতিক দল হতে বিচ্ছিন্ন করলেই হবে না। সত্যই যেন কোনও সংযোগসূত্র না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন