হোক চূড়ান্ত শাস্তি
সড়ক দুর্ঘটনায় রাজীবের মৃত্যু, আমার গৃহ সহকারী রোজিনার পা হারানোসহ বেশ কিছু ঘটনার পর পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাব ও এখাতে বিরাজমান নৈরাজ্য নিয়ে এখন বেশ সরব আলোচনা। আমি এ নিয়ে নিজে বহু বলেছি, লিখেছিও।
নৈরাজ্যের এ দিকটি আমরা দেখছি, এ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে গণপরিবহন নারীর জন্য যে, ভয়ংকরভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে সেই আলোচনা তেমন হচ্ছেনা। উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি বিষয়টি বড় করেই সামনে এনেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে গণপরিহনে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। তাও দিনে দুপুরে। লোকজনের কোলাহলের মধ্যেই। এর আগে এ ধরনের ঘটনার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে, ফেসবুকে অনেক মেয়েই এসব নিয়ে লিখছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রূপা খাতুন চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। দুর্বৃত্তরা তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যায়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলেও গণপরিবহনে নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। পথে পথে খুন করেই ক্ষান্ত নয় পরিবহন শ্রমিকরা, এবার তারা ধর্ষক ও নারী নির্যাতকও হয়ে উঠেছে।
একটি গণমাধ্যম শিরোনাম করেছে ‘গণপরিবহনে যৌন নির্যাতন যেন নারীর নিয়তি’। প্রতিনিয়তই গণপরিবহনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। রাষ্ট্র যখন উন্নয়শীল দেশের তকমা থেকে বেরিয়ে মধ্যম আয়ের পথে, তখন পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থনীতিতে সমানতালে অবদান রেখে চলেছেন নারীরাও। আর তাই প্রতিদিনই জীবিকার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে নারীদের।
যানবাহন সঙ্কটের শহরে ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে কখনো ভাগ্যে জুটে আসন, আর কখনো দাঁড়িয়েই যেতে হয় কর্মস্থলে। এত কিছুর পরও নিগ্রহের শিকার হওয়া যদি নারীর নিয়তি হয়, তাহলে কি জোর দিয়ে বলা যায় দেশ এগিয়েছে? দিন দিন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, একইসঙ্গে বাড়ছে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীকে সন্ধ্যাকালে ক্লাশ করতে হয়। গার্মেন্টসসহ অনেক বেসরকারি সংস্থায় কর্মজীবী নারীকেও রাত্রিবেলা পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে হয়।
রুপার ঘটনা এর মধ্যেই বলা হয়েছে। গত বছর ২৭শে অক্টোবর চট্টগ্রামে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এক পোশাক শ্রমিক। গত বছরের একই সময়ে বাড্ডা এলাকায় যৌন নিপিড়নের শিকার হন চাকমা তরুণী। এমন ঘটনা যেন দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক এবং অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের কাছ থেকেই নারীরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। এই হার ৬৬ শতাংশ।
কেন এমন হয় বা হচ্ছে? একটা বড় কারণ আইনের তোয়াক্কা না করা। এদেশের পরিবহন শ্রমিকরা জানে, তাদের কিছু হবেনা। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা পেশি ও রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী। শ্রমিকরা নিশ্চিত তারা যা ইচ্ছে করবে, এই মালিক শ্রমিক রাজনৈতিক কান্ডারীরা তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দিবে যত অন্যায়ই তারা করুক না কেন।
বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, তদারকির অভাব (সিসি ক্যামেরার অভাব) ইত্যাদি বিষয়গুলো নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ বলছে ব্র্যাক। কিন্তু বিষয়টি ঠিক এত সহজ নয়। মেয়েরা যৌনতার যন্ত্র— এমন ধারণাই আসল কারণ। আরও সব নির্যাতকের মতো, পরিবহন শ্রমিকরা শিখেছে নারী মানেই, তার সাথে যা ইচ্ছে করা যায়।
সরকার নারীশিক্ষা ও নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানা কাজ করছে। অথচ গণপরিবহনের যাতায়াতে নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব দৃশ্যমান। এক্ষেত্রে সরকারের নীরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মানুষ জানতে চায় পরিবহন খাতের নৈরাজ্য কী চলতেই থাকবে?
ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট অপরাধ ও দুষ্কর্ম বন্ধ করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু পরিবহন মালিকদেরওতো অনেক দায়িত্ব আছে। এমনসব অভিযোগের পরও মালিকরা যদি উদ্যোগী না হয় তাহলে, উচিত হবে সেইসব মালিকের ব্যবসার অধিকার কেড়ে নেয়া।
যখন নারীর সম্ভ্রম ও নিরাপত্তাই ঝুঁকির মুখে—তখন তো আর মুখ বুজে থাকা যায় না। গণপরিবহনে নারীর উপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির ঘটনার জন্য অনেকে বিচারহীনতাকে দায়ী করে থাকে। ঢালাওভাবে তা বলছিনা। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে। কিন্তু এগুলো মানুষকে আশ্বস্ত করে না, অপরাধীকে ভয় দেখায় না। গণপরিবহনের মালিক, শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনগুলি আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না।
তাই ধর্ষক ও নিগ্রহকারীদের কঠোর শাস্তি প্রয়োজন। বাস শ্রমিকদের বর্বরতা বিরল এবং চরম। এই বিশ্বের আলো-হাওয়ায় তাদের বাঁচার অধিকার থাকবে কিনা সেই ভাবনায় যাওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ চায় ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। চূড়ান্ত শাস্তি। শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস