ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তারেক রহমানের পাসপোর্ট বৃত্তান্ত!

তানভীর আহমেদ | প্রকাশিত: ০১:১১ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

লন্ডনে কমনওয়েলথ সামিটে এসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন। এই বক্তব্যের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঢাকায় গিয়ে অপর আরেকটি সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন, ৪ সেপ্টম্বর ২০০৮ সালে তারেক রহমান পাসপোর্ট ইস্যু করার পর ১২ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনে আসেন।

একই বছর তারেক রহমান তার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন। হাইকমিশন লন্ডন সেই পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নবায়ন করে। এরপর তিনি আর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেননি। ২০১৪ সালের ২ জুন তিনি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সপরিবারে পাসপোর্ট জমা দেন। সেখান থেকে তা বাংলাদেশের হাইকমিশনে আসে। মন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, "তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন।"

রহমান লন্ডনে চিকিৎসা নিতে আসার প্রায় ১০ বছর পর বিএনপির তরফ থেকে এই প্রথমবার তারেক রহমানের যুক্তরাজ্যের স্ট্যাটাস সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলো দলটির মহাসচিব। রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলে তারেক রহমানের স্ট্যাটাসটি পরিষ্কার করে নিলো আওয়ামী লীগ। তবে যে প্রশ্নটি এখনো পরিষ্কার হচ্ছে না সেটি হলো তারেক রহমান বর্তমানে কোন দেশের পরিচয় বহন করছেন? পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেহেতু নিশ্চিত করেছেন তারেক রহমান তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করেননি সেই অর্থে বর্তমানে তারেক রহমানের কাছে বাংলাদেশের কোন পরিচয়,পত্র থাকার কথা নয়।

যুক্তরাজ্যের আইনজীবী এ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান মিনার বলছিলেন যদি কোন ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে থাকে, সেক্ষেত্রে আবেদনকারীকে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বা হোম অফিসের কাছে পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। এধরনের আবেদনের সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আবেদনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পাসপোর্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকেই ফেরত দেওয়া হয়।

আর ভিসার অনুমতি দিয়ে একটি কার্ড ইস্যু করা হয়। কিন্তু তারেক রহমানের কেইসে যেহেতু পাসপোর্ট হাইকমিশনে পাঠানো হয়েছে তার অর্থ তারেক রহমান বা তার আইনজীবী নিশ্চয়ই বাংলাদেশের পাসপোর্ট নবায়ন হবে না বা তাকে নতুন পাসপোর্ট পেতে বাধার সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা জানিয়ে হোম অফিসে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট বাংলাদেশে হাইকমিশনে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তারেক রহমান বাংলাদেশের পরিচয়পত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্রিটিশ ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্টের জন্য আবেদন করে থাকতে পারেন।

এখানে একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। পরিচয়পত্র বা ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট হিসেবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার না করলে বা গ্রহণ না করলে তারেক রহমানের নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে যাবে না। তবে তারেক রহমান সম্ভবত বাংলাদেশী পাসপোর্টের পরিবর্তে ব্রিটিশ ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট চেয়ে আবেদন করেছেন। তিনি মনে করতে পারেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে তিনি পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। বিষয়টি এমন হতে পারে ব্রিটেনের হোম অফিস তারেক রহমানের আবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে মনে করেছে তারেক রহমানকে ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট দেওয়া প্রয়োজন। তাই তারা তাকে রিফিউজি ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট ইস্যু করে থাকতে পারে। তবে সেই ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্টে অবশ্যই তারেক রহমানের পরিচয় বাংলাদেশী হিসেবেই উল্লেখ করার কথা।

ব্যারিস্টার এ কে এম কামারুজ্জামান বলছেন, জেনেভা কনভেনশনের রিফিউজ এ্যাক্টের ১৯৫১ এর , প্যারাগ্রাফ ১৫ এ বলা আছে। কোন দেশের নাগরিক যদি অন্য কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং সেটি যদি গৃহীত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর সেই দেশের ( যদি আবেদন কারী বাংলাদেশী হয় তাহলে বাংলাদেশের) নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। তাই তারেক রহমানকে রাষ্ট্রহীন বা স্টেইটলেসও বলা যাবে না। তিনি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নবায়ন না করলেও বাংলাদেশী নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। যেহেতু ব্রিটেন দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রথা সমর্থন করে, সেই অর্থে তারেক রহমান বাংলাদেশ ও ব্রিটেন উভয় দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।

এবার আসা যাক রিফিউজি ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট বা রিফিউজি স্ট্যাটাস প্রক্রিয়াটি কি হতে পারে। তারেক রহমান যদি ২০১৩ সাল থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় ভোগ করে থাকেন তাহলে তিনি প্রথমে ৩ বছর পরবর্তীতে সেটিকে নবায়ন করে থাকলে এই স্ট্যাটাসে তিনি ৫ বছর অতিক্রম করেছেন। যুক্তরাজ্যে অভিবাসনের নিয়ম অনুযায়ী এধরনের আশ্রয়প্রার্থীরা চাইলে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করতে পারেন। তবে ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ হোসেল 'ল' এসোসিয়েটসের ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন বলছেন, কোন আবেদনকারীর ভিসা স্থায়ীভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে না যদি ওই ব্যক্তি কোন মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে থাকেন। সেই অনুযায়ী তারেক রহমান যেহেতু বাংলাদেশের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী সেই বিবেচনায় তারেক রহমানের স্থায়ীভাবে আবেদন গৃহীত নাও হতে পারে।

এছাড়াও তারেক রহমান ২০০৮ সালে থেকে ব্রিটেনে বৈধভাবে বসবাস করেছেন। ব্রিটেন ১০ বছর কেউ বৈধভাবে বসবাসের প্রমাণ দেখাতে পারলে সে মানবাধিকার গ্রাউন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রেও যদি আবেদনকারীর কোন ক্রিমিনাল কনভিকশন বা সাজা প্রাপ্ত আসামী হয়ে থাকেন তাহলে সেই আবেদনকারীকে স্পষ্টভাবে সেটি আবেদ পত্রে উল্লেখ করতে হয়। তবে তারেক রহমান যদি প্রমাণ করতে পারেন বাংলাদেশের আদালতের রায়ে তিনি ন্যায় বিচার পাননি, অথবা তার নামে দেওয়া মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত তাহলে তার আবেদনটিও বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে হোম অফিস।

তাহলে তারেক রহমানের বর্তমানে ইউকের স্ট্যাটাসটি খুব পরিস্কার। প্রথমত তারেক রহমানের কোন বাংলাদেশী কোন পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নেই। দ্বিতীয়ত তারেক রহমানকে ব্রিটেনের হোম অফিস রিফিউজি ট্রাভেলকার্ড দিয়ে থাকতে পারে। যে ট্রাভেলকার্ড দিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন। যেহেতু তিনি ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশ ছাড়া ব্রিটেনের বাইরে একাধিক দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং সেই সময়ে তার কোন বাংলাদেশী পাসপোর্ট ছিলো না, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারেক রহমান ব্রিটেনের ট্রাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করেই বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, বাংলাদেশী পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট দিয়ে নয়।

সাধারণত রাজনৈতিক রিফিউজিদের ক্ষেত্রে তারা নিজ দেশের পরিচয় পত্র দিয়েই নিজের দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করে থাকেন। সেই হিসেবে তারেক রহমানের বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম। তারেক রহমান হয়তো ব্রিটিশ ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে বিভিন্ন দেশে ট্রাভেল করছেন। তবে এই ডকুমেন্ট দিয়ে তিনি বাংলাদেশে ট্রাভেল করতে পারবেন না। বাংলাদেশে ফিরতে হলে তাকে বাংলাদেশী ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে হবে।

গতকাল একাত্তর জার্নালে এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণে যুক্ত হয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেব যুক্ত হয়ে ব্যারিস্টার তানজীবুল আলম বলছিলেন, তারেক রহমান যেহেতু আদালতের সাজাপ্রাপ্ত আসামি, একারণে বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডন তাকে সাধারণ নাগরিক সেবা নাও দিতে পারেন। এখন এই বিষয়টি হয়তো তারেক রহমান জানেন একারণেই তিনি পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করেনি।

এখানেও আরেকটি ফাঁক রয়ে গেছে কারণ তারেক রহমান বাংলাদেশের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন ২০১৬ সালে কিন্তু তার পাসপোর্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০১৪ সালে। তাহলে এই দুই বছর কেন তিনি তার পাসপোর্ট নবায়ন করলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাজ্যের আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোয়ার বললেন, তারেক রহমান যদি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নবায়ন করতেন তাহলে তার রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টি বিলম্বিত হতে পারতো। বাংলাদেশী পাসপোর্ট না থাকায় তারেক রহমানের রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হোম অফিসের জন্য সহজ হয়েছে।

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ভাবে দাবি তুলতেই পারে, তারেক রহমান ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী পাসপোর্ট নবায়নের সুযোগ থাকার পরও সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি কেন? অন্যদিকে তারেক রহমানের আইনজীবীর তরফ থেকে যুক্তি আসতে পারে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকলে তারেক রহমানের জন্য পলিটিক্যাল এসাইলাম পাওয়া কঠিন হতো এই বিবেচনা করে তারেক রহমানের পাসপোর্ট নবায়নের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকতে পারে। তবে তারেক রহমানের পাসপোর্ট বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একটি উপকার করেছেন, বিএনপিকে তারেক রহমানের বর্তমান স্ট্যাটাস পাবলিক করতে বাধ্য করেছেন তিনি যা এতোকাল গোপন ছিলো।

রাজনৈতিক দলের প্রধান এখন যে বিষয়টি নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে সেটি হচ্ছে, বিদেশে থাকা অবস্থায় কোন রাজনৈতিক দলের নেতার যদি বাংলাদেশী পরিচয়পত্র না থাকে তিনি কী একটি দেশের রাজনৈতিক দলের প্রধান থাকতে পারবেন কিনা? হওয়া কোন সাংবিধানিক পদ নয়, সেই অর্থে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেতে আইনগত কোন বাধা নেই বলেই বলছেন এ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান মিনার। তবে আইনগত কোন বাধা না থাকলেও নৈতিকভাবে এটি কতটুকু সমর্থনযোগ্য যখন রাজনৈতিক দলটির প্রধানের দেশে ফেরার কোন সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করতে পারছেনা দলটি।

লেখক : সাংবাদি ও কলামিস্ট, একাত্তর টেলিভিশনের লন্ডন প্রতিনিধি।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন